
এক সপ্তাহ ধরে পানিবন্দি ও কর্মহীন হয়ে পড়েছেন
ছাতকে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত মানুষের আর্তনাদ যেন থামছেইনা। বন্যায় তাদের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। গত রোববার থেকে ধীরগতিতে বাসা-বাড়ি থেকে পানি নামতে শুরু হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে দেখা দিয়েছে খাদ্য ও খাবার পানির তিব্র সঙ্কট। বন্যায় ভেসে গেছে অনেকের ঘর-বাড়ি, আসবাবপত্রসহ ধান-চাল ও গবাদিপশুর খাবার। পানির প্রবল স্রোতে ভেসে গেছে খামারের মাছ ও গবাদিপশু। এক সপ্তাহ ধরে পানিবন্দি ও কর্মহীন হয়ে পড়েছেন এখানের মানুষ। অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে বন্যা আর মানুষের কান্না একাকার হয়েছিল। বন্যার পানিতে ভেসে গিয়ে ও নৌকা ডুবে শিশুসহ ৩জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
জানা যায়, গত ১৫ জুন থেকে ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে ছাতক উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। ছাতক-সিলেট, ছাতক-আমবাড়িবাজার-সুনামগঞ্জ, জালালপুর-লামা রসুলগঞ্জ, কৈতক-ভাতগাঁও, ছাতক-আন্ধারীগাঁও-জাউয়াবাজার, গোবিন্দগঞ্জ-বসন্তপুর, বড়কাপন-শ্রীপুরবাজারসহ সবকটি সড়ক বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। এ কারণে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। প্রাণ বাঁচাতে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ স্থানে নিতে ছুটাছুটি করতে থাকে স্বজনরা। নৌকায়, সাঁতার কেটে, আবার কেউ কেউ ভেলায় ছড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করে। এসময় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় নৌকাই ছিল মানুষের যাতায়াতের এক মাত্র ভরসা। ব্যবধান ছিল ২০ টাকা গাড়ি ভাড়ার পরিবর্তে নৌকা ভাড়া ৫শ' থেকে ১হাজার টাকা। এ সুযোগে নৌকার মালিক-শ্রমিকরা ফুঁলে গেছে। ফুঁলে গেছে অসাধু কিছু মুদি দোকানিরাও। তারা ৫ টাকার মোমবাতি ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের কাছে বিক্রি করেছে ৩০টাকায়। শুকনো খাবারের মূল্য নিয়েছে দ্বিগুণ।
এদিকে, ছাতক-থেকে গোবিন্দগঞ্জে যাওয়ার পথে নৌকা ডুবে খালেদ আহমদ (৩০) নামের এক যুবক নিখোঁজ হয়। নিখোঁজের ৩দিন পর খারগাঁও মাধবপুর এলাকায় ভাসমান অবস্থায় তার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধারের পর দাফন করা হয়। সে উপজেলার ছৈলা-আফজলাবাদ ইউনিয়নের রাধানগর গ্রামের আহমদ আলীর পুত্র। বন্যায় কালারুকা ইউনিয়নের মুক্তিরগাঁও গ্রামের নিজ বাড়ি এলাকায় পানিতে ডুবে তমাল আহমদ (২০) নামের এক প্রতিবন্ধি যুবকের মৃত্যু হয়েছে। সে ওই গ্রামের ব্যবসায়ী শরিফ হোসেন সূরুজ আলীর পুত্র। বাড়ি থেকে পরিবারের সাথে জাউয়াবাজার ডিগ্রি কলেজে আশ্রয় কেন্দ্রে আসার পথে নৌকা ডুবে ৬ বছরের এক কন্যা শিশু নিখোঁজ হয়। নিখোঁজের ২দিন পর শিশুর লাশ হাওরে ভেসে উঠে।
এখানের বাতাসের সাথে চারদিকে লাশের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। নিখোঁজ আছেন কতজন তার কোন হিসেব মিলছেনা। ১৬ জুন থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত বিদ্যুৎবিহীন কাটিয়েছিলেন ছাতকের মানুষ। ছিলনা মোবাইল নেটওয়ার্ক। পানি কমতে শুরু হওয়ায় রোববার রাত থেকে কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। মোবাইল নেটওয়ার্কের সুবিধাও পেয়েছে ওইসব এলাকার মানুষ।
অপরদিকে উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ এখনও পানিবন্দি রয়েছেন। উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গ্রাম এলাকার দ্বিতল ভবনে ছাদে ছামিয়ানা টানিয়ে বসবাস করছেন মানুষ। হাট-বাজারের কোন দ্বিতল ভবন খালী নেই। সব ভবনের উপরেই মানুষ। অন্যদিকে এ সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মূল্যে খাদ্যসহ মালামাল বিক্রি করার অভিযোগ উঠেছে। গত শনিবার থেকে ছাতকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা টহলে নিয়োজিত আছে। মানুষকে উদ্ধার করে স্পিডবোর্ড যোগে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়াসহ সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে তাদের গাড়ি দিয়ে মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে দেখা গেছে। ছাতক সদর হাসপাতাল ও কৈতক ২০ শয্যা হাসপাতালে এখনও রয়েছে পানি।
ছাতক থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহবুবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে থানার উপ-পরিদর্শক মহিন উদ্দিন বলেন, বন্যায় নৌকাডুবে এখানে কতজন লোক মারা গেছে এ বিষয়ে থানায় কোন লিখিত তথ্য নেই। স্বজনরাও লাশ উদ্ধারের তথ্য পুলিশকে দেয় নাই।
ইসলামপুর ইউপির চেয়ারম্যান এড.সুফি আলম সুহেল, নোয়ারাই ইউপির চেয়ারম্যান দেওয়ান পীর আব্দুল খালিক রাজা ও চরমহল্লা ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাসনাত বলেন, তাদের ইউনিয়নে শত শত ঘরবাড়ি, অনেক মৎস্য খামার ও সবজি বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে সকল হাটবাজার। এখনও অনেক মানুষ বিভিন্ন প্রতিষ্টান ও বাড়ীর ছাদে অবস্থনে করছেন।
সিংচাপইড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহাব উদ্দিন সাহেল জানান, বন্যার শুরু থেকেই আমি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষের খোঁজ খবর নিয়েছি শোকনা খাবার বিতরণ করছি। মঙ্গলবার থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে সিংচাপইড় ইউনিয়নে ত্রানসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়াও উপজেলা আওয়ামীলী, যুবলীগ, সেচ্ছাসেবকলীগ, ছাত্রলীগসহ এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে দেয়া চাউল, ডাল, আলো, পিয়াজ সহ ত্রাণসামগ্রী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে দফায় দফায় বিতরণ করছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্ম মামুনুর রহমান বলেন, উপজেলার শতাধিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন উচু ভবনে বন্যা দুর্গতদের আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে খুলে দেওয়া হয়েছে। সার্বক্ষনিক খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। বন্যা দূর্গত এলাকায় প্রতিদিনই সরকারী ত্রাণ বিতরন করাচ্ছে।
ছাতক পৌরসভার মেয়র আবুল কালাম চৌধুরী বলেন, বন্যায় ছাতক শহরের প্রায় ৯৫ ভাগ মানুষের ঘরে পানি ছিল। পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে ছুটাছুটি করেন। একদম অসহায় হয়ে পড়েছিলেন সাধারন মানুষ। বন্যার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত শহরের প্রতিটি এলাকায় পৌরসভার পক্ষ থেকে রান্না করা খাবার বিতরণ করে আসছি। যে কোন দুর্যোগে আগামীতেও মানুষের পাশে থেকে কাজ করতে আমি সব সময় প্রস্তুত আছি।
ছাতক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান জানান, আমরা এখনো পানির উপর ভাসছি। পানি কমতে হবে, সড়ক পথে গাড়ি চলতে হবে। পানি না কমলে, গাড়ি না চললে সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ পৌঁছাতে সমস্যা হবে। তিনি বলেন, সোমবার উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের বন্যাদুর্গত মানুষের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।