ছবি:সংগৃহীত
বাংলাদেশে সম্প্রতি নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। মূলত মিয়ানমারের আরাকানে সামরিক জান্তা ও বিদ্রোহী আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে সংঘর্ষের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে রোহিঙ্গারা।
বাংলাদেশে বর্তমানে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি। এরমধ্যে ৮ লাখ রোহিঙ্গা এসেছে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে। সরকার অবশ্য বলছে, নতুন করে আর একজন রোহিঙ্গাকেও আশ্রয় দেয়ার মতো অবস্থায় নেই বাংলাদেশ।
তবে এরপরও নতুন করে রোহিঙ্গা আসা থেমে নেই। বাংলাদেশ সরকারের হিসেবে, গত দেড় মাসে নতুন এমন অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা ৮ হাজারেরও বেশি। তবে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, বাস্তবে নতুন করে ঢোকা রোহিঙ্গার সংখ্যা এর দ্বিগুণ।
মিয়ানমারে সংঘর্ষ চলতে থাকায় বাংলাদেশ যেন নতুন করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয় সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দিক থেকে চাপ রয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গঠিত নতুন অন্তবর্তীকালীন সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করতে পারবে কি না- সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
হঠাৎ কেন রোহিঙ্গারা ঢুকছে?
মিয়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া গ্রাম শিকদারপাড়া। সেখানকার বাসিন্দা জেসমিন মাসখানেক আগে এসেছেন বাংলাদেশে। সঙ্গে তার স্বামী ও এক সন্তানও এসেছে। বাংলাদেশে আসার পর তারা অবস্থান নিয়েছেন কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে।
জেসমিনের বক্তব্য অনুযায়ী, গেলো মাসে শিকদারপাড়ায় আরাকান আর্মির ছোড়া বোমার স্প্লিন্টারের আঘাতে গুরুতর আহত হওয়ার পর বাংলাদেশে না এসে আর কোনো উপায় ছিলো না তাদের। বোমার স্প্লিন্টার তার ডান পায়ে আঘাত করার পর সেই পা কেটে ফেলতে হয় বলে জানান জেসমিন।
‘দুপুরের দিকে আমি বাসাতেই ছিলাম। হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দ শুনতে পাই। তারপর আর কিছু মনে নেই। কারণ আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমার ডান পা থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। মিয়ানমারে চিকিৎসার কোনো সুযোগ ছিলো না। শুধু ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। আমার প্রাণ বাঁচাতে আমার স্বামী পরিবার নিয়ে বাংলাদেশ চলে আসতে বাধ্য হয়।’
জেসমিনের পরিবার নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। এখানে ঢোকার পর তার আশ্রয় হয় একটি আন্তর্জাতিক এনজিও’র হাসপাতালে।
জেসমিন বলেন, ‘মিয়ানমারে আমার ঠিকমতো চিকিৎসা হয় নাই। ওই অবস্থাতেই একদিন পর বাংলাদেশে ঢুকি। এখানে চিকিৎসা চলতে থাকলেও পরে দেখা যায়, ডান পায়ে আঘাতের জায়গায় ইনফেকশন হয়েছে। পরে ইনফেকশনের কারণে আমার পা কাটতে হয়। তবে পা হারালেও আমি বেঁচে আছি, আমার পরিবার বেঁচে আছে। এটাই স্বান্তনা।’ জেসমিনের পরিবার বলছে, তারা আর মিয়ানমারে ফিরতে চান না।
সীমান্ত পেরিয়ে কীভাবে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা?
বাংলাদেশে আসা নতুন রোহিঙ্গারা জানাচ্ছেন, সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার অংশে এখনও অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢোকার অপেক্ষায় আছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়াতে তারা রাতের বেলায় নৌকায় করে নাফ নদী পেরিয়ে ঢোকার চেষ্টা করেন।
জেসমিন জানান, তার ভাষায়, গুরুতর আহত হওয়ায় ‘মিয়ানমারের সেনা সদস্যরাই তাকে পরিবারসহ একটি ছোট নৌকায় উঠিয়ে দেয়’। ভোর চারটার দিকে তাদের নৌকা নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এজন্য নৌকার মাঝিকে দিতে হয়েছে ৪০ হাজার টাকা।
জেসমিনের মতোই সপ্তাহ দুয়েক আগে বাংলাদেশে ঢোকেন আছিয়া। ২০১৭ সালে তার বাবা-মা বাংলাদেশে এলেও আছিয়া তার স্বামীর সঙ্গে মিয়ানমারেই থেকে যান। কিন্তু এখন মিয়ানমার জান্তার সঙ্গে বিদ্রোহীদের সংঘর্ষের তীব্রতা বাড়ায় জীবন নিয়ে মিয়ানমারে বেঁচে থাকার উপায় নেই। আছিয়ার স্বামী ওসমান গনি বলেন, ‘যুদ্ধের মধ্যে এখন মিয়ানমারে থাকা সম্ভব নয়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা কিন্তু এর আগেরবার বাংলাদেশে আসিনি। সেখানে আমাদের বাড়িঘর আছে, জমি আছে, সম্পদ আছে। কিন্তু এখন যেভাবে দুই পক্ষ গোলাগুলি করছে, তারা দেখছে না যে, কে সাধারণ মানুষ আর কে যোদ্ধা। আমাদের গ্রামে যখন বোমায় মানুষ মারা গেলো, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, মিয়ানমারে আর থাকা যাবে না।’
কিন্তু তারা বাংলাদেশে ঢুকলেন কীভাবে? ওসমান গনি জানান, প্রথমে পায়ে হেঁটে তারা বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে এসেছেন। তার কথায়, ‘আমাদের গ্রামে প্রথমে আরাকান আর্মি ড্রোন হামলা করে। তখন আমরা গ্রামের বেশ কিছু লোক দুইদিন পাশের একটা বনে লুকিয়ে ছিলাম। কোনো খাবার ছিল না। কিন্তু সেখানেও আরাকান আমি ড্রোন দিয়ে বোমা মেরেছে। পরে আমরা নদীতে গলা পানিতে ডুবে থেকে কোনোমতে জীবন বাঁচাই। আমরা সীমান্তের কাছে চলে আসি।’
ওসমান গনি আরও বলেন, নদী পারাপারের জন্য তাদের কাছে কোনো টাকা ছিলো না। বহু কষ্টে নদী পার হওয়ার জন্য একজন মাঝির সঙ্গে চুক্তি করেন তারা। চুক্তি অনুযায়ী, স্বামী-স্ত্রী এবং সন্তানের জন্য ২০ হাজার টাকা দিতে হয় মাঝিকে।
ওসমানের কথায়, ‘আমরা যেন বাংলাদেশের কোস্টগার্ডের কাছে ধরা না পড়ি সেজন্য মধ্যরাতে নৌকা ছাড়ে। আমাদেরকে নামানো হয় শাহপরী দ্বীপের কাছে। পরে নৌকার মাঝি আমাদেরকে স্থানীয় একটি গ্রামে একটা ঘরে নিয়ে রশি দিয়ে বেঁধে রাখে। ক্যাম্পে আমাদের আত্মীয়ের কাছে ফোন দিলে তারা এসে চুক্তির ২০ হাজার টাকা তুলে দেয় মাঝিকে। এরপর তারা আমাদের ছেড়ে দেয়।’ ওসমান জানান, মিয়ানমারে তার বাবা-মা আছেন। কিন্তু তারা বেঁচে আছেন কি না তিনি জানেন না।
কোথায় থাকছেন এসব রোহিঙ্গা?
বাংলাদেশে গত দেড় মাসে নতুন করে যেসব রোহিঙ্গা ঢুকেছে, সরকারি হিসেবে তাদের সংখ্যা ৮ হাজারেরও বেশি। সম্প্রতি অন্তবর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান।
কিন্তু স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, বাস্তবে এ সংখ্যা সরকারি হিসেবের চেয়ে দ্বিগুণ। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের সরকার আশ্রয় না দেয়ায় তারা গোপনে বিভিন্ন আত্মীয়স্বজন এবং পূর্বপরিচিতদের ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। এতে করে আগে থেকেই গাদাগাদি অবস্থায় থাকা পরিবারগুলো নতুন করে চাপে পড়েছে।
ক্যাম্পে আগে থেকে বাস করছেন এমন একজন রুহুল আমিন। তিনি জানান, তার ৫ সদস্যের পরিবারে নতুন করে আসা আত্মীয় অবস্থান করছেন ৪ জন। পাঁচজনের জন্য যে বরাদ্দ সেখান থেকেই চলছে ৯ জনের খাবার। এভাবে কতদিন চলবে তা নিয়ে সন্দিহান রুহুল আমিন। তার দাবি, নতুন আসা রোহিঙ্গাদের যেন বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃতি দেয়। তাহলে তারা নতুন ঘর এবং খাবারসহ অন্যান্য বারদ্দ পাবেন।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে সরকার কী বলছে?
বাংলাদেশে এবারের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ এমন এক সময় ঘটছে, যখন এখানে গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন অন্তবর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিয়ানমারে নতুন করে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাংলাদেশের ওপর বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপ থাকলেও শেখ হাসিনা সরকার সেটা অগ্রাহ্য করেছে। কিন্তু নতুন সরকার সেটা কতটা পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
তবে গত সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বিবিসিকে এক সাক্ষাতকারে সাফ জানিয়ে দেন, বাংলাদেশ নতুন করে কোনো রোহিঙ্গা গ্রহণ করবে না। তিনি বলেন, ‘গত সাত/আট বছর ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী করেছে? এটার সমাধান তো ওইপারে (মিয়ানমারে)। তারা শুধু আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে গেছে, বার্মার ওপর তেমন কোনো চাপ সৃষ্টি হয়নি। এটা এভাবে চলতে পারে না। আমাদের পক্ষে আর কাউকে নেয়া সম্ভব না। এমনকি যারা এসেছে, আমরা তাদেরকে নিবন্ধন করাব না।’
তৌহিদ হোসেন আরও বলেন, নতুন রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন করলে, সেটা আরও রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশে উৎসাহিত করবে। তার কথায় ‘আমরা জানি যে, রোহিঙ্গারা সমস্যার কারণে এসেছে। কিন্তু এই সমস্যা শুধু আমাদের দেশের জন্য না, এটা গোটা পৃথিবীর জন্য সমস্যা। পৃথিবীকেই এর দায়িত্ব নিতে হবে। যারা ঢুকে গেছে, আমরা তাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করব। কিন্তু আমরা তাদের আনুষ্ঠানিক কোনো রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দেব না, এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।’
কিন্তু রোহিঙ্গারা বিজিবি ও কোস্টগার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে ঢুকছে এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ‘কিছু দুর্বলতা’ থাকার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘একটা বিরাট এলাকা দিয়ে সমুদ্র বা নদীপথে তারা ঢুকছে। অনুপ্রবেশের সংখ্যা এলার্মিং না। কিন্তু আমরা তাদের ঠেকানোর চেষ্টা করছি। এখানে কিছু দুর্বলতা তো অবশ্যই আছে। কারণ নদী ও সাগর মিলিয়ে এলাকাটা তো বিশাল। আমরা তো আমাদের পুরো বর্ডার গার্ডকে সেখানে মোতায়েন করতে পারব না। আমাদের তো অন্যদিকেও সীমান্ত আছে।’
একদিকে বাংলাদেশ নতুন করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে ইচ্ছুক নয়। অন্যদিকে নানামুখী চেষ্টার পরও রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কোনো উদ্যোগ সফল হয়নি। এর মধ্যে মিয়ানমারে সংঘাতেরও সমাধান দেখা যাচ্ছে না। ফলে এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ না চাইলেও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ থেমে নেই।
সূত্র: বিবিসি