ছবি:সংগৃহীত
ঢাকার অবৈধ রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে সেবা সংস্থাগুলো। সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ৩ শতাধিক রেস্তোরাঁয় অভিযান চালানো হয়। এ সময় ১৪টি ব্র্যান্ডের রেস্টুরেন্ট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অগ্নিনিরাপত্তার দুর্বলতায় ১টি ভবনে সিলগালা ও ৫ প্রতিষ্ঠানকে ৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
রেস্তোরাঁ পরিচালনায় ত্রুটি পাওয়ায় সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৪৪৪ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত জরিমানা পরিশোধের শর্তে তাদের জামিন দেন।
সোমবার একযোগে ঢাকার সব এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এবং ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
ত্রিমুখী সাঁড়াশি অভিযানে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বেস্তোরাঁ মালিক ও রেস্তারাঁর ভবন মালিকরা। নগর সংস্থাগুলো এই অভিযানকে রুটিন কাজের অংশ দাবি করে অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, হঠাৎ রেস্টুরেন্ট বন্ধের অভিযান অযৌক্তিক। কেননা জাতীয় বিল্ডিং কোডে রেস্তোরাঁ কোথায় হবে, তার পরিষ্কারভাবে কোনো ক্যাটাগরি দেওয়া নেই। এজন্য বাণিজ্যিক ভবনে রেস্তোরাঁ গড়ে উঠছে, পেশাজীবীরাও একই সুপারিশ করছেন। বিষয়টি সমাধান করতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকার সংশ্লিষ্টদের আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। কোনো নোটিশ বা আলোচনা ছাড়া অভিযান করে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়ায় ব্যবসায়ীরা মারাÍক ক্ষতির মুখে পড়বে এবং এতে অনেক মানুষ বেকার হবে; কার্যত কোনো সুফল মিলবে না।
সোমবার বেলা ১১টার দিকে ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কে অভিযান পরিচালনা শুরু করে রাজউক। এ সময় ওই সড়কের গাউসিয়া টুইন পিক ভবনের রুফটপ রেস্তোরাঁ ভেঙে দেয় রাজউকের উচ্ছেদকারী দল। এছাড়া ওই ভবনের ১২টি রেস্তোরাঁ সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে।
রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজিনা সারোয়ার বলেন, ভবনটিতে অফিস করার অনুমোদন দেওয়া থাকলেও রেস্তোরাঁ করার অনুমতি ছিল না। আইন ভেঙে রেস্তোরাঁ করায় গত ২৩ মে রাজউক ওই ভবন মালিককে নোটিশ দিয়েছিল; তবুও তারা নিজেদের শুধরে নেয়নি।
সরেজমিন দেখা যায়, রাজউকের অভিযানে ধানমন্ডি সাতমসজিদ সড়কের ওই ভবনের রুফটপের রেত্রো লাইফ কিচেন নামের রেস্তোরাঁটি ভেঙে ফেলা হয়। অভিযানে স্পাইস হারবস নামের একটি রেস্তোরাঁকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ওই রেস্তোরাঁর মালিক রাইসুল আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, এ ভবনের বাণিজ্যিক অনুমোদন থাকায় রেস্তোরাঁ করা হয়েছে। এর যে আলাদা অনুমোদন নিতে হবে, তা জানতাম না। গাউসিয়া টুইন পিক ভবনের ব্যবস্থাপক শহিদুল ইসলাম বলেন, স্থপতি যেভাবে ভবনের নকশা করেছেন, সেভাবেই ব্যবহার চলছে। তারা বাণিজ্যিক হিসাবে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে রেস্তোরাঁর অনুমোদন নিয়েছে। এতদিন কোনো অসুবিধা ছিল না। এখন রাজউক ভিন্ন কথা বলছে।
এদিকে পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় গতকাল দুপুর ২টায় ধানমন্ডি কেয়ারি ক্রিসেন্ট প্লাজাকে সিলগালা করে দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এ সময় রূপায়ণ জেড আর প্লাজার ৪ প্রতিষ্ঠানকে ৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অভিযানে নেতৃত্ব দেন ডিএসসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ধানমন্ডি সাতমসজিদ রোডে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এ সময় বেশির ভাগ রেস্টুরেন্ট বন্ধ পাওয়া গেছে। অভিযানের সময় ফায়ার সার্ভিসের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) জানিয়েছে, রোববার বিকাল থেকে সোমবার বিকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা মহানগরীর রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়েছে আটটি বিভাগের থানা পুলিশ। এই অভিযানে বেশির ভাগ রেস্তোরাঁয় ফায়ার এক্সটিংগুইশার পাওয়া যায়নি। যেগুলোতে আছে সেগুলো মেয়াদ উত্তীর্ণ । এছাড়া কোথাও অনেক পুরোনো ফায়ার এক্সটিংগুইশার পাওয়া গেছে। কিন্তু নতুন লেভেল লাগানো, ২০২৪ সালের তারিখও বসিয়েছে রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ।
তারা আরও জানিয়েছে, অভিযানে বহুতল ভবনে গড়ে ওঠা অধিকাংশ রেস্তোরাঁ ভবনের অতিরিক্ত কোনো এক্সিট পাওয়া যায়নি। যে সিঁড়ি আছে, তাও অত্যন্ত সরু। একই বিল্ডিংয়ে শপিংমল ও রেস্তোরাঁ রয়েছে অসংখ্য স্থানে। শপিংমলের ঢল, রেস্তোরাঁর বস্তা, অব্যবহৃত চুল্লি, গ্যাস সিলিন্ডার এসব আবার সিঁড়িতে রাখা। রেস্তোরাঁর অধিকাংশ রান্নাঘর অপরিচ্ছন্ন ও ঘিঞ্জি। কোনো কোনো রান্নাঘর ছয় ফিট বাই আট ফিট। সেখানে ৫ থেকে ৬ জন বাবুর্চি কাজ করে। ওইসব রুমে আবার দু-তিনটি বড় ইলেকট্রিক ওভেন, ৪ থেকে ৫টি গ্যাস সিলিন্ডার রাখা। সব মিলে এক মৃত্যুকূপে চলছে রেস্তোরাঁর কার্যক্রম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আবাসিক ও অফিস ভবনে রেস্তোরাঁ পাওয়া গেছে।
পুলিশের তথ্যমতে, রোববার বিকাল থেকে ডিএমপির আটটি বিভাগে টানা ২৪ ঘণ্টার অভিযান চালিয়ে এমন নানা ব্যত্যয় পাওয়ায় ৪৪৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাজধানীজুড়ে ২৮৫টি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের বেশিরভাগই রেস্তোরাঁর মালিক, ম্যানেজার ও কর্মচারী। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) কে. এন. রায় নিয়তি বলেন, বিভিন্ন রেস্তোরাঁর ২৪ ঘণ্টার অভিযানে ৪৪৪ জন গ্রেফতার হয়েছেন। ওইসব রেস্তোরাঁয় কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হচ্ছিল না। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলছিল কার্যক্রম।
তিনি বলেন, অভিযানে ডিএমপি অধ্যাদেশ অনুযায়ী ২১৫টি প্রসিকিউশন করা হয়েছে। এছাড়া প্রচলিত আইনে পাঁচটি মামলাও দেওয়া হয়েছে।
ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, সোমবার থেকে ডিএমপির রমনা, লালবাগ, ওয়ারী, মতিঝিল, তেজগাঁও, মিরপুর, গুলশান ও উত্তরা বিভাগের ৫০টি থানা এলাকায় একযোগে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। নগরবাসীর নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় রেখে এসব রেস্তোরাঁ-ভবনে জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রয়েছে কিনা, তা দেখতেই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সব থেকে বেশি ৪৫টি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়েছে ওয়ারী বিভাগ। এসব অভিযানে গ্রেফতার করা হয়েছে ২৬ জনকে। এছাড়া আটক করা হয়েছে ১৬ জনকে। অভিযানে সব থেকে বেশি ৯৬ জনকে গ্রেফতার করেছে তেজগাঁও বিভাগ।