Banglar Chokh | বাংলার চোখ

১৪ নিরাপত্তা স্তর পেরিয়ে পাসপোর্ট, টিকিট, বোর্ডিং পাশ ছাড়া কুয়েত বিমানে এক শিশু

জাতীয়

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

সর্বশেষ

১৪ নিরাপত্তা স্তর পেরিয়ে পাসপোর্ট, টিকিট, বোর্ডিং পাশ ছাড়া কুয়েত বিমানে এক শিশু

ছবি:সংগৃহীত

হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ১৪ স্তরের নিরাপত্তা ডিঙিয়ে পাসপোর্ট, টিকিট, বোর্ডিং পাশ ছাড়া এক শিশু নির্বিঘ্নে কুয়েত এয়ারওয়েজের এক ফ্লাইটে উঠেছে। এ ঘটনায় হতভম্ব ওই ফ্লাইটের পাইলট, ক্রুসহ সব যাত্রী। পুরো ফ্লাইটটির ৩৩০ আসনে যাত্রী পূর্ণ থাকায় কেবিন ক্রুরা ওই শিশুটিকে কোনো সিট দিতে পারছিলেন না। একপর্যায়ে আসন ছাড়া কীভাবে শিশুটি ফ্লাইটে উঠল এ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর পর বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্তরের নিরাপত্তাকর্মীরা ছুটে আসেন ফ্লাইটে। এরপর বেরিয়ে আসে শাহজালালের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভয়াবহ চিত্র। এ ঘটনায় কুয়েত এয়ারওয়েজের কেইউ-২৮৪ ফ্লাইটটি প্রায় আধা ঘণ্টা দেরিতে ঢাকা ত্যাগ করেছে। বিমানটিতে ৩৩০ জন প্যাসেঞ্জার ছিলেন। মঙ্গলবার রাত আনুমানিক ৪টা ১০ মিনিটে এ ঘটনাটি ঘটে। এদিন দুপুরে বিমানবন্দরের ডিউটি সিকিউরিটি অফিসার (ডিএসও) খুরশিদা খাতুন বিমানবন্দর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। এরপর শিশুটির অভিভাবকদের থানায় ডেকে পাঠানো হয়।  

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিমানবন্দরের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে দেখছেন কীভাবে শিশুটি বিমানবন্দরে প্রবেশ করেছিল এবং ফ্লাইটে উঠেছিল। তারা দেখতে পান, ইমিগ্রেশন, অ্যাভসেক তল্লাশি ও সিকিউরিটি চেক না করে শিশুটি নির্বিঘ্নে ফ্লাইটে উঠে যাচ্ছে। এটি দেখে অবাক হয়ে পড়েন সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও বিমানবন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে বহনকারী ভিভিআইপি ফ্লাইটটি এয়ারপোর্ট ত্যাগ করার মাত্র ১০ ঘণ্টা পর বিমানবন্দরের এমন চিত্র পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এটি শুধু কোনো অ্যাডভেঞ্চার বলে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। এর সঙ্গে অন্য কোনো রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে বলে তাদের ধারণা। কিংবা বিমানবন্দরের কোনো আদম পাচার সিন্ডিকেটের হাত থাকতে পারে এর সঙ্গে। কারণ ১০-১২ বছরের অজপাড়াগাঁয়ের একটি শিশুর পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয় বিমানবন্দরের এত গেট ডিঙিয়ে ফ্লাইটে ওঠা। কেউ না কেউ তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছে। কিংবা পুরো ঘটনাটি সুপরিকল্পিতও হতে পারে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, এই ঘটনায় প্রথমে ইমিগ্রেশন ও সিকিউরিটির সঙ্গে জড়িত সবাইকে সাসপেন্ড করতে নির্দেশ দিয়েছি। এরপর তদন্ত করা হবে। তিনি বলেন, কীভাবে ইমিগ্রেশন পার হলো সেটা আমারও প্রশ্ন। তিনি ধারণা করছেন ইমিগ্রেশন করার সময় হয়তো কোনো পরিবারের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারপর ওই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সেও পার হয়ে গেছে। তারপরও এটা তদন্ত করে দেখা হবে।

শিশুটির নাম জুনাইদ মোল্লা। বয়স আনুমানিক ১২ বছর। গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর থানার বরইহাটি গ্রামের বাঁশবাড়িয়ায় তার বাড়ি। বাবার নাম ইমরান মোল্লা, মাতার নাম জেসমিন আক্তার।

কুয়েত এয়ারওয়েজের স্টেশন ম্যানেজার মাসরুরুল ইসলাম চৌধুরী সুমন বলেন, ফ্লাইটটির সব আসনে যাত্রী থাকায় কেবিন ক্রুদের কাছে ধরা পড়ে শিশুটির উপস্থিতি। কারণ তারা ওই শিশুটিকে কোনো আসন দিতে পারছিলেন না। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে তারা কুয়েত এয়ারওয়েজের পাইলট ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন। শিশুটির কাছে এ সময় কোনো টিকিট, পাসপোর্ট, বোর্ডিং পাশ ছিল না। এমনকি তার সঙ্গে কোনো লাগেজ, হ্যান্ডব্যাগও ছিল না। ফ্লাইটে ওই সময় তার কোনো আত্মীয়স্বজন কিংবা কোনো প্রতিবেশীও ছিল না। শিশুটি এ সময় কেবিন ক্রুদের কোনো প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারছিল না। প্রথমে তারা ধারণা করছিলেন শিশুটি বোর্ডিং পাশ পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু বোর্ডিং মেশিন তল্লাশি করে দেখতে পান এই নামে কোনো বোর্ডিং পাশ ইস্যু হয়নি। শিশুটির শরীর তল্লাশি করে তার পকেটে একটি টেলিফোন নম্বর পাওয়া যায়। ওই নম্বরে ফোন করলে এক মহিলা ফোন রিসিভ করেন। শিশুটি জানায়, ওই মহিলা তার দাদি। পরে তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিশুটিকে তারা ২ দিন ধরে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। কিভাবে ১০ বছরের এই শিশু গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকা এসে বিমানবন্দরে প্রবেশ করল এবং নিরাপত্তার ১৪ স্তর ডিঙিয়ে কুয়েত এয়ারওয়েজের উড়োজাহাজে উঠল তাতে তিনিও হতভম্ব হয়ে যান। তবে তিনি জানান, জুনাইদ মোল্লা খুবই দুরন্ত টাইপের ছেলে। দেখতে হাবাগোবা মনে হলেও সে খুই চালাক ও দুষ্ট প্রকৃতির। এর আগেও সে একাধিকবার হারিয়ে গিয়েছিল। পরে খোঁজাখুঁজি করে আবার তাকে পাওয়া যায়।

বিমানবন্দরের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ফ্লাইটটি যখন উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে সময় ১০-১২ বছরের একটি ছেলে শিশু প্লেনের ভেতরে করিডোরে হাঁটাচলা করছিল। কেবিন ক্রু শিশুটিকে সিটে বসার পরামর্শ দেন। তখন শিশুটি একটি সিটে বসে পড়ে। একপর্যায়ে শিশুটি যেই সিটে বসেছিল পাশের সিটের যাত্রী শিশুটিকে তার বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে বসতে বলে। কিন্তু শিশুটি তার বাবা-মায়ের বিষয়ে কোনো কিছু বলতে পারেনি। পাশের সিটের যাত্রী বিষয়টি কেবিন ক্রুর নজরে আনলে কেবিন ক্রু তাকে বাবা-মার বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন। তবে শিশুটি উত্তর দিতে পারেনি। একপর্যায়ে কেবিন ক্রুরা হেড কাউন্ট করেন (যাত্রী সংখ্যা গণনা করা)। তখন একজন যাত্রী বেশি পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানবন্দর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আজিজুল হক মিয়া বলেন, শিশুটি আমাদের হেফাজতে রয়েছে। তার বাবা-মা এলে সিনিয়র অফিসারদের পরামর্শ নিয়ে শিশুটির বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এভসেকের পরিচালক উইং কমান্ডার মিরান বলেন, শিশুটির বাবা-মার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা গোপালগঞ্জে থাকেন। তারা ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছেন।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান পরিচালনা পর্যদের সাবেক বোর্ড মেম্বার কাজী ওয়াহিদ উল আলম বলেন, কপাল ভালো এয়ারক্রাফটে প্যাসেঞ্জার ফুল ছিল। না হলে এই প্যাসেঞ্জার বাধাহীনভাবে কুয়েত বিমানবন্দরে পৌঁছে যেত। সেখানে গিয়ে ধরা পড়ত। আর তা যদি হতো তাহলে পুরো দেশের ভাবমূর্তি সংকটে পড়ত। পুরো এভিয়েশন সেক্টর ভাবমূর্তি সংকটে পড়ত। খুবই আতঙ্কিত হওয়ার মতো ঘটনা। তিনি বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। মাত্র ১০ ঘণ্টা আগে একটা ভিভিআইপি ফ্লাইট ছিল। এত আইনকানুন, এত এজেন্সি কাজ করছে বিমানবন্দরে। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ছেলেটি চলে গেল। তাছাড়া একদম বাচ্চা শিশু না ১০-১২ বছরের কিশোর। এখানে অবশ্য সিকিউরিটি শিথিলতা ও গাফিলতি ছিল। কাজেই কোনোভাবেই এই ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবে দেখা ঠিক হবে না। অবশ্যই এ নিয়ে সূক্ষ্ম তদন্ত করতে হবে। অন্যথা পুরো দেশ ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে। তিনি আরও বলেন, এই সিকিউরিটি শিথিলতার কারণে আমেরিকার ফেডারেশন এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) কর্তৃক শাহজালালকে গ্রেড-২ করা হয়েছে। সেখানে কিভাবে এ ঘটনা ঘটল তা চিন্তাও করা যায় না। এ নিয়ে আরও কঠোর হতে হবে। কঠোর ভাবে তদন্ত করতে হবে। সিকিউরিটি সিস্টেম আরও কঠোর ও ইন্টিগ্রেটেড হতে হবে।

বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বর্তমানে শাহজালালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই অত্যাধুনিক ও নিচ্ছিদ্র। একজন আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জারকে ১৪টি নিরাপত্তা স্তর ডিঙিয়ে তারপর ফ্লাইটে উঠতে হচ্ছে। কোনো প্যাসেঞ্জারের পকেটে একটি আলপিন থাকলেও সেটি নিরাপত্তা স্ক্রিনিংয়ে ধরা পড়ে। কোনো প্যাসেঞ্জার বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে চাইলে প্রথমে গেটে থাকা আনসার সদস্যকে পাসপোর্ট-টিকিট দেখিয়ে তারপর ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। এরপর আর্চওয়ের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে ফের নিরাপত্তাকর্মীর মাধ্যমে পুরো শরির তল্লাশি করতে হয়। এরপর বোর্ডিং কার্ড ও পাসপোর্ট দেখিয়ে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে প্রবেশ করতে হয়। ইমিগ্রেশন শেষ করে একজন নিরাপত্তাকর্মীকে বোর্ডিং কার্ড দেখিয়ে বিমানবন্দরের গ্রিন এরিয়ায় প্রবেশ করতে হয়। এরপর ফাইনাল গেটে জুতা, ঘড়ি, বেল্ট খুলে এবং স্ক্রিনিং মেশিনে ব্যাগ স্ক্রিনিং করে বোর্ডিং কার্ড দেখিয়ে ফাইনাল রুমে প্রবেশ করতে হয়। এই গেটে বোর্ডিং কার্ডের অর্ধেক অংশ কেটে রাখে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তারা। এরপরও দুই দফায় বোর্ডিং কার্ডের বাকি অংশ দেখিয়ে উড়োজাহাজে প্রবেশ করতে হয়। এভাবে মোট ১৪টি স্তর ডিঙিয়ে একজন প্যাসেঞ্জারকে উড়োজাহাজে প্রবেশ করতে হয়। কিন্তু এত স্তরের কোথাও নিরাপত্তাকর্মীরা শিশুটির বোর্ডিং কার্ড, পাসপোর্ট দেখতে চাইল না এটাই প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ইমিগ্রেশন চেকিং ও ইমিগ্রেশন কাউন্টার পার হয়ে বিমানবন্দরের ট্রানজিট এরিয়ার প্রবেশ। এছাড়া অ্যাভসেক তল্লাশি শেষে এয়ারলাইন্সের ফাইনাল গেট পার হলো কিভাবে-সেই প্রশ্ন সবার মুখে মুখে।

শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম বলেন, শিশুটি কীভাবে বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করল এবং কীভাবে নিরাপত্তা স্তরগুলো পার হলো তা তদন্ত করে খুঁজে বের করা হবে। যারা গাফিলতি করেছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দায়ীদের শাস্তি দেওয়া হবে। বেবিচক চেয়ারম্যান তাকে জানিয়েছেন যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে আইনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নিতে।

উৎসঃ যুগান্তর

সর্বশেষ

জনপ্রিয়