Banglar Chokh | বাংলার চোখ

পার্বত্য চুক্তির ২৬ বছরেও রক্তাক্ত পাহাড়,ফেরেনি শান্তি (ভিডিও)

জাতীয়

আলমগীর মানিক,রাঙামাটি

প্রকাশিত: ০১:২৪, ২ ডিসেম্বর ২০২৩

আপডেট: ০৭:৫৭, ২ ডিসেম্বর ২০২৩

সর্বশেষ

পার্বত্য চুক্তির বর্ষপূর্তি আজ। ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পাহাড়ের বিরাজমান সশস্ত্র তৎপরতার বন্ধে অত্রাঞ্চলের জনগণের পক্ষে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়ে শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলো সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জেএসএস।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এর মাধ্যমে পাহাড়ে প্রায় আড়াই দশকের বেশি সময় ধরে চলা শান্তি বাহিনী নামক গেরিলা বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে তিন পার্বত্য জেলায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান ঘটানোর প্রত্যাশাই ছিল চুক্তির মূল উদ্দেশ্য।

কাগজে কলমে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নাম হলেও দেশ বিদেশের পর্যবেক্ষকরা এই চুক্তির নাম দিয়েছিল শান্তিচুক্তি। চুক্তির ফলে প্রধানমন্ত্রী দেশ বিদেশে প্রশংসা পাওয়ার পাশাপাশি নানা পুরস্কার ও উপাধী অর্জন করেন। শান্তির আশায় চুক্তি করে সন্ত্রাসীদের পুনর্বাসন ও নানাভাবে প্রভূত সুযোগ সুবিধা দেওয়া ছাড়াও সেনাক্যাম্প গুটিয়ে নেওয়ার আজ ২৬ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। কিন্তু সবুজ-শ্যামল ছায়া সুনিবিড় পার্বত্য চট্টগ্রামে আজও শান্তি অধরা। দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় ইতিমধ্যেই পাহাড়ের অভ্যন্তরে বিরাজ করছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বারুদের গন্ধ। প্রতিনিয়তই স্থানীয় ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের বলি হওয়া মানুষের রক্তের রক্তিম হচ্ছে পাহাড়ে পরিবেশ।

সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন দায়িত্বশীল সরকারী একাধিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে পাহাড়ে সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত থাকা সন্ত্রাসীদের হাতে চুক্তির পূর্ববর্তি সময়ে ১৯৭৪ থেকে পাহাড়ে ব্যাপকহারে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে সেসময়কার শান্তিবাহিনীর সদস্যরা। এই পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে নিহত, আহত ও অপহরণ/নিখোঁজের শিকার হয়েছে অন্তত ৮১৪০ জন। তার মধ্যে পাহাড়ি ১১৩৮, বাঙ্গালী ১৪৪৬ নিয়ে নিহত হয়েছে সর্বমোট ২৫৮৪ জন। এই সময়ের মধ্যে আহত হয়েছে (উপজাতীয়-৮২০, বাঙ্গালী-১৭৯৮) ২৬১৮ এবং অপহরণের শিকার হয়েছে (উপজাতীয়-১৮০০,বাঙ্গালী-১১৩৬ জন)সর্বমোট ২৯৩৬ জন।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের রক্ষাসহ অত্রাঞ্চলের ভূখন্ড রক্ষায় দায়িত্বপালন করতে গিয়ে উপজাতীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হামলায় সেই একাত্তর থেকে চলতি ২০২২ এর সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সর্বমোট ৩৮০ জন বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য শহীদ হয়েছে। তারমধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর-১৭১, বিজিবি’র-১১১, পুলিশের-৩২ ও আনসার ব্যাটালিয়নের রয়েছে ৩৮০জন। এই সময়ের মধ্যে আহত হয়েছে ৪৪৬জন। আহতদের মধ্যে ২৪১জন সেনা সদস্য,বিজিবি’র ১০২, পুলিশের ৯০, আনসার বিডিপির রয়েছে ১৬ জন।

পাহাড়ের মানুষের আত্মসামাজিক উন্নয়নে পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বমোট ৪৬০০ কিলোমিটার সড়ক পথ নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে চুক্তির পূর্বে  ১৯৭২ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত ছিলো ১১৬০ কিমি: আর চুক্তির পরবর্তীতে চলতি ২০২৩ পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে ৪ হাজার কিলোমিটার সড়ক। এছাড়াও সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হচ্ছে ১০৩৬ কিলোমিটার সড়ক। আগামী ২০২৪ সালের ৩০শে জুন এই প্রকল্পটি শেষ হবে বলে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনষ্টাকশন সূত্রে জানাগেছে।  

এখন পর্যন্ত পার্বত্যাঞ্চলের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সরকারী ৪৩টি হাসপাতাল,বেসরকারি হাসপাতাল-১৬টি, সরকারী ৩৮৫টি ক্লিনিক, বেসরকারী-৫১ নিয়ে সর্বমোট ৪৯৫টি হাসপাতাল/ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ইতিমধ্যেই তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসহ সর্বমোট ৭৩২৯টি শিল্প-কলকারখানা স্থাপন করা হয়েছে। তারমধ্যে কল-কারখানা সরকারি-৮টি, বেসরকারী-৩২টি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সরকারী-১১টি ও বেসরকারি-৭২৮৮টি রয়েছে।

এতোকিছুর পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামে থেমে নেই হত্যার রাজনীতি। অত্রাঞ্চলে বিগত ২৬ বছরে ৯৫০জন পাহাড়ি,৪৫০ বাঙ্গালীসহ সামরিক/আধাসামরিক বাহিনীর মোট ১৪০০ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে সর্বমোট ২ হাজার জন। চুক্তির পরবর্তী সময়ে ২৬ বছরে পাহাড়ে অপহরণের শিকার হয়েছে সর্বমোট ২২৫০ জন।

এতোগুলো সন্ত্রাসী কার্যক্রমের পাশাপাশি জাতিস্বত্তার কথা বলে নিজেদের স্বার্থের জন্য বিপুল অংকের অর্থের জন্য দেশদ্রোহি জঙ্গিগোষ্ঠিদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে পাহাড়ি উপজাতীয় আঞ্চলিকদলগুলো। এতে করে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন মোটেও সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন চুক্তি সম্পাদনকারী কমিটির অন্যতম সদস্য রাঙামাটির এমপি দীপংকর তালুকদার।

এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, চুক্তির পর থেকেই সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস এর সন্ত্রাসীদের হাতে ব্যাপকহারে মার খাচ্ছে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা। পাশাপাশি চুক্তির বিরোধীতাকারি সংগঠন ও রাজনৈতিকগুলোর সাথে প্রকাশ্যে জোট করে ব্যাপকহারে চাঁদাবাজি, সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত থাকাদের সাথে নিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের রোডম্যাপ মোটেও সম্ভব নয়। তিনি সকলকে তাদের ভূল পথ পরিহার করে একই মঞ্চে আসার আহবান জানিয়ে বলেন, আওয়ামীলীগ চুক্তি করেছে আওয়ামীলীগই এটার বাস্তবায়ন করবে কিন্তু আস্থার জায়গাটা সৃষ্টিতে সকলের এক হতে হবে। অন্যথায় কিছুই হবেনা।

বিশ্লেষকদের মতে পার্বত্য চুক্তির পর পাহাড়ে হতাহতের সংখ্যা প্রায় দুইগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিষয়টি অত্যান্ত উদ্যোগজনক।
পাহাড়ের এখনো চাঁদাবাজি অস্ত্রবাজি রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন চুক্তি সম্পাদনকারি দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জেএসএস এর সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার। তিনি বলেন, অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিক, তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করুক আমরা জেএসএস এর পক্ষ থেকে সরকারকে সহযোগিতা করবো। সাবেক এই সংসদ সদস্য বলেছেন, ২৬ বছরেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আশাতীত বাস্তবায়ন করা হয়নি। উল্টো সরকারের একটি পক্ষ চুক্তি বিরোধীদের সাথে আতাঁত করে চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ করছে। পার্বত্য সমস্যাকে স্থায়ীভাবে সমাধানের লক্ষে নির্দিষ্ট্য রোডম্যাপ ঘোষনার কোনো বিকল্প নেই।

চুক্তির ২৬ বছর পর আজো প্রশ্ন উঠছে আসলেই কি পাহাড়ে শান্তি ফিরেছে? প্রশ্নটির উত্তরে যে কেউ বিনা বাক্যে বলতে বাধ্য যে, শান্তিতো আসেই বরং খুন-চাঁদাবাজির ক্ষেত্র আরো সম্প্রসারিত হয়েছে। সে সময়ে জনসংহতি সমিতি নামে একটি মাত্র আঞ্চলিক সংগঠন ছিল; যাদের সশস্ত্র শাখা ছিল শান্তি বাহিনী। আর চুক্তির পর এই সংগঠন থেকেই জন্ম হয়েছে ইউপিডিএফ থেকে শুরু করে গুন্ডুস বাহিনীসহ আরো ছয়টি সশস্ত্র সংগঠনের। যাদের আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্ধ প্রতিনিয়ত বিষিয়ে তুলছে পাহাড়ের পরিবেশ। এদিকে চুক্তির কারণে পাহাড় থেকে সেনা ক্যাম্প গুটিয়ে নেওয়ার কারণে দিনে দিনে পাহাড়-সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়ে উঠেছে।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়