মহানন্দ অধিকারী মিন্টু, পাইকগাছা থেকে
প্রকাশ: ০২:৫৯, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫
ছবি -বাংলার চোখ
গত ৫ বছরে দু’দফায় মেয়াদ ও ব্যায়বরাদ্দ বাড়িয়েও শেষ করা যাচ্ছে না খুলনার বেতগ্রাম-কয়রা আঞ্চলিক মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। প্রতি নিয়ত নতুন নতুন সংকটে আটকে যাচ্ছে প্রকল্পের বাঁক সরলীকরনের কাজ। সর্বশেষ বাঁক সরলীকরণ নিয়ে পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি সদরের ফকিরবাসা মোড় এলাকায় অধিগ্রহনকৃত প্রায় সাড়ে ১১ শতক জমির মালিক ও সওজের মধ্যে সেখানকার নকশা সংক্রান্তে মতপার্থক্য এমনকি অধিগ্রহণের অর্থ পরিশোধ নিয়ে আইনী জটিলতায় আটকে গেছে সেখানকার সরলীকরনের কাজ।
সমস্যা সমাধানে ইতোমধ্যে খুলনা জেলা প্রশাসন ও সওজের তত্ত্বাবধায়নে প্রকল্প এলাকা কপিলমুনিতে ১৫ ডিসেম্বর সোমবার ক্ষতিগ্রস্ত জমি মালিক সহ এলাকাবাসীর উপস্থিতিতে গণশুনানী ও বৃহস্পতিবার জমি মালিকদের সাথে জেলা প্রশাসনের পৃথক বসাবসিতেও নিষ্পত্তি হয়নি সমস্যার।
এদিকে গুণশুনানী ও তৎপূর্ব ক্ষতিগ্রস্থ জমি মালিকসহ স্থানীয়দের অভিযোগ, বাঁক সরলীকরণে স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যাবসায়ীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি রক্ষা করতে বিতর্কিত নকশা করা হয়েছে। এছাড়া এই নকশায় বাক সরলীকরণ বাস্তবায়নে কাজ করছে সওজ ও জেলা প্রশাসন। যদিও সড়ক ও জনপদ বিভাগ (সওজ) বলছে, অটোকাড সফটওয়ারের মাধ্যমে এ বাকগুলো সরলীকরণ নক্শা প্রস্তুত করা হয়েছে। এখানে কারোও প্রতি কোন প্রকার পক্ষপাতিতত্বের সুযোগ নেই। সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, ‘খুলনার ৩ উপজেলা ডুমুরিয়া, পাইকগাছা ও কয়রা, এবং সাতক্ষীরার একটি তালা উপজেলার ওপর দিয়ে বেতগ্রাম কয়রা ভায়া তালা-কপিলমুনি ও পাইকগাছার প্রায় ৬০ কিলোমিটার সড়কটি দুই লেনে উন্নীত করণে মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে তৎকালীণ সরকার। প্রকল্পে সড়কের ঝুঁকিপূর্ণ ৩৪টি বাঁক সরলীকরণে জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। ২০২০ সালে শুরু হয় কার্যক্রম। প্রায় ৫ বছরে দু’দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়। যা চলমান রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে শুরু থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল দীর্ঘ সড়কের ৩৪টি বাক সরলীকরন। ইতোমধ্যে প্রায় সবগুলো বাক সরলীকরণে জমি অধিগ্রহনপূর্বক কাজ শুরু হলেও বাধ সাধে পাইকগাছার কপিলমুনি বাজারের ফকিরবাসা মোড় এলাকা সরলীকরণে। সেখানকার ১১.৩৯০ শতক জমি অধিগ্রহনে অসম দর নির্ধারণ ও অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করে আসছেন চিহ্নিত জমির মালিকরা। ইতোমধ্যে তারা এলাকাবাসীকে সাথে নিয়ে রীতিমত আন্দোলন-সংগ্রামে নেমেছেন। যেখানে অভিযোগ করা হচ্ছে, স্থানীয় এক ব্যাবসায়ীর বাণিজ্যিক ও বাসভবন রক্ষা করতে তৎকালীণ এমপি আক্তারুজ্জামান বাবু মোটা অংকের অর্থ বাণিজ্য করে নকশা পরিবর্তন করেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে গত ৬ ডিসেম্বর বর্তমান নকশায় উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে সওজ। সেখানে মাদ্রাসার একটি একাডেমিক ভবন উচ্ছেদের পর স্থানীয় এক প্রয়াত সাংবাদিক, একজন আইনজীবির পরিবার, একজন রাজনৈতিক নেতা, একটি সেলুন ঘরসহ একাধিক স্থাপনা উচ্ছেদের অন্তিম মূহুর্তে অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণের টাকা বুঝে না দিয়ে কাজ চলমান রাখায় বাধ সাধেন তারা। এরপর গত ১৫ ডিসেম্বর ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদানে একটি গণশুনানীর আয়োজন করে খুলনা জেলা প্রশাসকের অধিগ্রহণ শাখা। এলক্ষে গত ১০ ডিসেম্বর ভূমি অধিগ্রহন কর্মকর্তা ইমরান হাসান স্বাক্ষরিত ৩১.৪৪. ৪৭০০.০১৪.৯৯.১৪৩.২৫-৭১৬ নম্বর স্মারকের একটি অনুলিপি সরবরাহ করা হয় ক্ষতিগ্রস্থ মালিকদের বরাবর। এদিন গুণশুনানী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, সওজের খুলনা নির্বাহী প্রকৌশলী তানিমুল হক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দীপঙ্কর দাশ সহ সওজ ও জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ।
এদিকে খুলনার কয়রা-বেতগ্রাম আঞ্চলিক সড়ক নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষ করে বাঁক সরলীকরণ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে শুরু থেকেই যৌথভাবে কাজ করছে জেলা প্রশাসন ও সওজ। ৩৪টি বাকের অন্যতম কপিলমুনিস্থ ফকিরবাসা বাক সরলীকরণে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে তারা একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও রীতিমত ব্যার্থ হয়েছেন। নকশা অনুযায়ী বাঁকটি সরলীকরণের কাজ শেষ করতে পারলেই প্রকল্পের অন্যান্য কাজ দ্রুত সম্পন্ন হবে বলে দাবি করেছেন প্রকল্প বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, প্রায় ৬৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কয়রা-বেতগ্রাম আঞ্চলিক সড়কটি যথাযথ মানে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি। এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল ৩৪টি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক সরলীকরণের পাশাপাশি সড়ক প্রশস্ত ও মজবুতকরণের মাধ্যমে উপকূলের কয়েক লাখ মানুষের জেলা শহরে যাতায়াত নির্বীঘ্নে করা। ২০২২ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও একাধিকবার সময় বাড়িয়ে এখন পর্যন্ত ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানানো হয়। প্রকল্পের আওতায় থাকা অধিকাংশ ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক সরলীকরণের কাজ কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়াই শেষের পথে। মাত্র একটি বাঁকের জটিলতার কারণে প্রকল্পের চলমান কাজ থমকে গেছে বলে দাবি করা হচ্ছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের পক্ষে।
কপিলমুনির স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার মধ্যে অন্যতম বৃহৎ ব্যবসায়িক মোকাম কপিলমুনি। সপ্তাহের প্রতি রবি ও বৃহস্পতিবার সেখানে হাট বসে। বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ী-কৃষকরা পাইকারি ও খূচরা মালপত্র কেরা-বেঁচা করতে আসেন এ হাটে। গত প্রায় ৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে সড়কটির এ অংশের বেহাল অবস্থায় ফেলে রাখায় বাজারে যাতায়াতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন ক্রেতারা। এছাড়া কয়রা-খুলনা ভায়া পাইকগাছার একমাত্র সড়ক এটি হওয়ায় প্রতিনিয়ত শত শত বিভিন্ন শ্রেণির বাস,ট্রাক, পরিবহন সহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচলে চরম দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। স্থানীয় গাড়িচালকরা জানিয়েছেন, ঝুঁকিপূর্ণ কপিলমুনির বাজারের অদূরে সড়কের এ বাঁকটির কারণে প্রায়ই ছোট-বড় দুর্ঘটনায় পড়তে হচ্ছে তাদের। তাছাড়া কাজ অসমাপ্ত রাখায় সড়কের প্রায় দুইশ মিটারজুড়ে অসংখ্য গর্ত বর্ষা মৌসুমে যা রীতিমত খাদের সৃষ্টি করে। এক পসলা বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় সড়কের এ অংশ। গণশুনানিতে উপস্থিত থাকা নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) পাইকগাছা উপজেলা কমিটির সভাপতি এইচ এম শফিকুল ইসলাম বলেন, এখানকার মূল সমস্যা হলো বাঁক সরলীকরণের জন্য অধিগ্রহণকৃত জমি ও স্থাপনার অর্থ প্রাপ্তি নিয়ে। আবার অধিকৃত জমির কাগজ-পত্র নিয়েও রয়েছে অভ্যন্তরীণ জটিলতা।অধিগ্রহণের টাকা পাওয়ার জন্য জেলা প্রশাসন থেকে জমির বৈধ কাগজপত্র উপস্থাপন করতে বলায় সংকট বেড়েছে খানিকটা। যে কারণে অনেকেই চাইছেন না সড়কের এই স্থানে বাঁক সরলীকরণের কাজ এখনই সম্পন্ন হোক।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সড়কের বাঁক সরলীকরণের ওই স্থানের একপাশে কপিলমুনি জাফর আউলিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অবস্থান। অধিগ্রহণের চিঠি পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির অংশের স্থাপনা ভেঙ্গে নির্মাণকাজের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ঠিক তার সামনে মরহুম শেখ সামজেদুল ইসলামের দুই ছেলেদের দখলীয় বাড়িসহ স্থাপনা। এছাড়া সড়কের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া জমিতে মৃত জীতেন্দ্র নাথ সাহার ওয়ারেশদের মালিকানাধীন দোকানসহ আরোও দু’ব্যক্তির আরও দুটি স্থাপনা। অধিগ্রহণের চিঠি পাওয়ার পরও স্থাপনাগুলি ভাঙ্গা হয়নি। আর এসব স্থাপনাগুলি ভাঙ্গা-গড়া নিয়েই যত বিপত্তি। তাদর দাবি, নকশা পরিবর্তন করে সড়কের বিপরীত পাশের স্থাপনা উচ্ছেদ হলেই বাঁক সরলীকরণ সহজ হবে। তা নাহলে আরেকটি বাঁকের সৃষ্টি হয়ে যাতায়াতের পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে মাদ্রাসার নব নির্মিতন আইসিটি ভবনটি। কপিলমুনি জাফর আউলিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মাওলানা জামিরুল ইসলাম বলেন, কয়রা-বেতগ্রাম সড়কের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক এটি। দুর্ঘটনা এড়াতে এই বাঁকটি সোজা করা জরুরি মনে করে অধিগ্রহণের চিঠি পাওয়ার পর পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাদ্রাসা অংশের স্থাপনা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। অন্যান্য স্থাপনাগুলি সরানোর বিষয়টি নিতান্তই তাদের। প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মোজাহার এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপক হুমায়ুন কবির খোকন বলেন, প্রকল্পের সমগ্র কাজের মধ্যে মাত্র ২শ মিটার এ বাঁকটি সরলীকরণে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। কাজ বন্ধ রাখায় গোটা প্রকল্পে এর প্রভাব পড়ছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) দীপঙ্কর দাশ বলেন, সড়কের বাঁক সরলীকরণের জন্য ওই স্থানে প্রায় ১২ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। যার প্রায় ৪ শতাংশ জমি সরকারি পেরিফেরিভুক্ত হওয়ায় তার দখলীয় মালিক পক্ষের সাথে ক্ষতিপূরণ দাবি নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী তানিমুল হক বলেন, প্রকল্পের আওতায় ৩৪টি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকের মধ্যে মাত্র ১টি বাকের সরলীকরণে প্রতি মূহুর্তে নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অন্যগুলোর সরলীকরণে কোন ঝামেলা না থাকায় এ সব এলাকায় কাজ চলমান রয়েছে। তবে সর্বশেষ বাঁক সরলীকরণেও চেষ্টা চলছে। অচীরেই এর সমস্যা সমাধান হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।