ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০০:২২, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫
ছবি :সংগৃহীত
নয়াদিল্লির বাংলাদেশ হাউজের সামনে চরমপন্থি হিন্দু সংগঠনের নজিরবিহীন বিক্ষোভ এবং হাইকমিশনারকে উদ্দেশ্য করে গালমন্দ-হুমকি প্রদানের প্রেক্ষিতে দিল্লি ও আগরতলায় ভিসা সেবা বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ। অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের ওই দুই মিশনে ভিসা সেবা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হয় বলে নিশ্চিত করেছে সেগুনবাগিচা ও মিশনদ্বয়ের দায়িত্বশীল সূত্র।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ক্রমেই তিক্ত হয়ে উঠছে। দুই প্রান্তের সাম্প্রতিক নানা ঘটনা পরিস্থিতিকেই রীতিমতো বিষিয়ে তুলেছে। শনিবার রাতে দিল্লির নিরাপদ কূটনৈতিক জোনের বাংলাদেশ হাউজের গেটে গিয়ে বিক্ষোভ দেখায় একদল উগ্রপন্থি। তারা চাণক্যপুুরির একের পর এক নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে একেবারে রাষ্ট্রদূতের বাসভবনের সামনে (সড়কের ডিভাইডারে) গিয়ে অবস্থান নেয় এবং হাইকমিশনারের বাসভবন লক্ষ্য করে বাংলাদেশবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। তারা হাইকমিশনারকে উদ্দেশ্য করে উচ্চস্বরে গালমন্দ এবং নানা হুমকি দেয়।
ঢাকায় প্রাপ্ত রিপোর্ট বলছে এ ঘটনার সময় বাসভবনে থাকা বাংলাদেশ দূত এবং তার পরিবারের সদস্যরা চরম আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন। শনিবার স্থানীয় সময় রাত ৯টার দিকে অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্রসেনার ব্যানারে একদল উগ্রপন্থি বাংলাদেশ হাউজের মূল ফটকে অবস্থান নেয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।
ওদিকে গতকাল পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে হিন্দুত্ববাদীরা বিক্ষোভ করে বাংলাদেশের ভিসা সেন্টার বন্ধ করে দিয়েছে। উগ্রবাদীরা বিক্ষোভ করেছে কলকাতা উপ-হাইকমিশনের সামনে।
হিন্দুত্ববাদীদের বিক্ষোভ-ভাঙচুর
বন্ধ শিলিগুড়ির ভিসা কেন্দ্র: পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে বাংলাদেশের ভিসা কেন্দ্র ভাঙচুর করেছে হিন্দুত্ববাদী কয়েকটি সংগঠনের সদস্যরা। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ এনে মিছিল নিয়ে কেন্দ্রে গিয়েছিলেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (বিএইচপি), হিন্দু জাগরণ মঞ্চ ও শিলিগুড়ি মহানগর সংগঠনের সদস্যরা।
সোমবার বাংলাদেশের ভিসা কেন্দ্রে ভাঙচুরের পর সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ‘ডিইউডিজিটাল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান শিলিগুড়িতে বাংলাদেশের ভিসা কেন্দ্র পরিচালনা করে।
জানা যায়, শিলিগুড়ির বাঘা যতীন পার্কে জমায়েত হয় এই কয়েকটি সংগঠনের কয়েকশ’ নেতাকর্মী। এরপর তারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বাংলাদেশের ভিসা অফিস ঘেরাও করেন। এ সময় ভাঙচুর করা হয় ভিসা কেন্দ্রটি। তারা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর নির্যাতন বন্ধ, দিপু দাসের হত্যার বিচার ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি জানান। পরে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে পাঁচজনের একটি প্রতিনিধিদল ভিসা অফিসে গিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এবং প্রতিবাদস্বরূপ ভিসা অফিস বন্ধ রাখতে বলে। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে শিলিগুড়ি ভিসা কেন্দ্রের নিরাপত্তা জোরদারের অনুরোধ জানিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কলকাতা দপ্তরে চিঠি দিয়েছে কলকাতায় বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশন।
কলকাতায় উপ-হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ:
বাংলাদেশে নৈরাজ্য এবং সংখ্যালঘু হিন্দু নির্যাতনের প্রতিবাদে সোমবার কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের সামনে পৃথকভাবে প্রতিবাদ মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে জাতীয় কংগ্রেস, নাস্তিক মঞ্চ এবং বিভিন্ন হিন্দুবাদী সংগঠন। গতকাল দুপুরে জাতীয় কংগ্রেস বাংলাদেশে নৈরাজ্য এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে একটি বিক্ষোভ মিছিল করে। একপর্যায়ে মিছিলকারীরা কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকার বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের দিকে যেতে চাইলে, পুলিশ মিছিল আটকে দেয়। সেখানে মিছিলকারীরা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদ জানায়। সেøাগান দেয়। এরপরে কংগ্রেসের ৫ সদস্যের একটি দল উপ-হাইকমিশনে গিয়ে তাদের প্রতিবাদ জানায়।
এর আগে নাস্তিক মঞ্চের পক্ষ থেকেও দুই সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল উপ-হাইকমিশনে দিয়ে প্রতিবাদ জানান। এ ছাড়া এদিন বিকালে বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন কলকাতার নিজাম প্যালেস থেকে একটি প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে কলকাতাস্থ বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের দিকে গেলে পুলিশ তাদেরও আটয়ে দেয় বেকবাগান মোড়ে। এই প্রতিবাদ মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা ও বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী।
উল্লেখ্য, দুই দেশের কূটনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে রোববার বিকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন। তাছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে পৃথক বিবৃতিও প্রচার করা হয়। ওই ঘটনায় দিল্লির বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্রের বরাতে প্রেসনোটও ইস্যু করা হয়। যেখানে এ সংক্রান্ত বাংলাদেশি মিডিয়ার রিপোর্টকে অতিরঞ্জন বলে দাবি করা হয়। বিশেষত: বাংলাদেশ দূতকে হুমকি দেয়ার বিষয়টি দিল্লি পুরোপুরি অস্বীকার করে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দিল্লির প্রেসনোটকে একবাক্যে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন দিল্লির সুরক্ষিত কূটনৈতিক এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতের বাসভবন পর্যন্ত চরমপন্থিরা প্রবেশ করতে পারলো কীভাবে? এটাকে গুরুতর নিরাপত্তা ঘাটতি উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন ২৫ বা ৩০ জনের একটা হিন্দু চরমপন্থি সংগঠনের একটা দল এতদূর পর্যন্ত আসতে পারবে কেন একটা স্যানিটাইজড এলাকার মধ্যে। তার মানে তাদের আসতে দেয়া হয়েছে। তাহলে যেভাবে তারা আসছে, আসতে পারার কথা না কিন্তু নরমালি এবং তারপরে সেখানে তারা দাঁড়িয়ে শুধু ওই হিন্দু নাগরিকের হত্যার প্রতিবাদে স্লোগান দিয়ে চলে গেছে তা না, তারা অনেক কিছু বলেছে সেটা আমরা জানি এবং আমাদের পত্রপত্রিকায় যে রিপোর্টটা আসছে সেটাকে তারা বলছে মিসলিডিং এটাও সত্য না। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেন- আমার কাছে প্রমাণ নেই যে, হাইকমিশনারকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু আমরা এটাও শুনেছি, তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমরা ভরসা রাখছি যে ভারত যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেবে। কারণ হাইকমিশনার এবং তার পরিবার ওখানে বাস করে তারা থ্রেটেন ফিল করেছে এবং তারা কিন্তু আতঙ্কিত হয়েছে যে কারণ এডিকুয়েট সিকিউরিটি অফ ছিল, দুইজন গার্ড ছিল তারা চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। কাজেই এটাকে আমরা মনে করি যে আরেকটু পৃথক করাটা সত্যিকারই ওই দেশের দায়িত্ব।
ওদিকে দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে নিরাপত্তা বেষ্টনী ভাঙার চেষ্টা হয়নি বলে দাবি করে ভারত সরকার। দেশটির বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল রোববার এক বিবৃতিতে বলেন, ওই ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের কিছু মিডিয়ায় বিভ্রান্তিকর প্রপাগান্ডার বিষয়টি আমরা জেনেছি। প্রকৃত সত্য হলো, ২০শে ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে ২০ থেকে ২৫ জন যুবক সমবেত হয়। তারা ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাসের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন। একইসঙ্গে বাংলাদেশে সব সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা রক্ষার আহ্বান জানায়। কোনো সময়ই তারা নিরাপত্তা বেষ্টনী বা নিরাপত্তা পরিস্থিতি লঙ্ঘন করার উদ্যোগ নেয়নি। কয়েক মিনিট পরেই সেখানে থাকা পুলিশ ওই গ্রুপকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সবার দেখার জন্য এ বিষয়ে ভিজ্যুয়াল প্রমাণ আছে। ভিয়েনা কনভেনশনের অধীনে বিদেশি মিশন/পোস্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভারত। একই বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে আবর্তিত পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রেখেছে ভারত। জয়সওয়াল বলেন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন আমাদের কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে আমাদের দৃঢ় উদ্বেগের কথা অবহিত করেছেন তারা। দীপু চন্দ্র দাসের বর্বর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানাই আমরা।
উৎস:মানবজমিন