ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২২:৫২, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫
ছবি :সংগৃহীত
ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে প্রশাসনে পদোন্নতি ও পদায়ন নিয়ে একের পর এক যে বিতর্ক হচ্ছে তারমধ্যে সর্বশেষ সংযোজন হলো ড. মোহাম্মদ জিয়াউল হকের সচিব পদে পদোন্নতির ইস্যুটি। ২২ ডিসেম্বর সোমবার তাকে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা এটিকে ফ্যাসিস্ট পুনর্বাসনের ‘নতুন নজির’ বলে আখ্যায়িত করছেন। এবং আলী ইমাম মজুমদার, ড. শেখ আব্দুর রশীদ, অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এ বি এম আব্দুস সাত্তার ও জনপ্রশাসন সচিব মো. এহছানুল হকের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেটকে এরজন্য দায়ী করা হচ্ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সচিবালয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ধাওয়া খেয়ে পালিয়েছিলেন এই জিয়াউল হক। তিনি এখন সিনিয়র অনেককে ডিঙিয়ে সচিব পদে পাদোন্নতি বাগিয়ে নিলেন। এ কারণেই ‘নতুন নজির’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।
প্রশাসন ক্যাডারের ১৭ ব্যাচের এই কর্মকর্তা সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে তিনি সাবেক ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গোপন ফান্ডের ক্যাশিয়ার ছিলেন। ২০১৫ সালে উপসচিব হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পদায়ন পান জিয়াউল হক। সেই থেকে ৫ আগস্ট, ২০২৪ হাসিনা সরকারের পতন পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে বহাল থাকেন। সর্বশেষ ৫ আগস্টের সময় ছিলেন অতিরিক্ত সচিব পদে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সিপিটি উইংয়ের দায়িত্বে। একই সময়ে আরেক বহুল আলোচিত ফ্যাসিস্ট কমকর্তা সায়লা ফারজানাও ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। সায়লা ফারজানার পদায়ন ছিলো অতিরিক্ত সচিব (সংযুক্তি) হিসেবে। সায়লা ফারজানার আরেক পরিচয় হলো- বহুল আলোচিত, গুম-খুনে জড়িত, অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামের স্ত্রী।
৫ আগস্ট, ২০২৪ হাসিনা সরকার পালিয়ে যাওয়ার পর জিয়াউল হক এবং সায়লা ফারজানা উভয়েই গা-ঢাকা দিয়ে থাকেন কয়েকদিন। সচিবালয়ে আসেন ১৩ আগস্ট, ২০২৪। আওয়ামী লীগ আমলে বঞ্চিত শত শত কর্মকর্তা ওই সময় প্রতিদিনই সচিবালয়ে শো-ডাউন করছিলেন। ১৩ আগস্ট সকালে সায়লা ফারজানাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দেখা মাত্রই বঞ্চিত কর্মকর্তারা তার ওপর চড়াও হন। কয়েকজন কর্মকর্তা তাকে চরম নাজেহাল অবস্থা থেকে উদ্ধার করে গাড়িতে তুলে পুলিশী প্রহরায় বাসায় পাঠিয়ে দেন। এরপরেই বঞ্চিত কর্মকর্তাদের হাতে লাঞ্চিত হন সিপিটি উইংয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ জিয়াউল হক। ঠেলা-ধাক্কাসহ তার গায়ে হাতও তুলেন কেউ কেউ। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তিনি দ্রুত সচিবালয় ত্যাগ করেন। এ সময় পেছন থেকে উচ্চকণ্ঠে ‘ধর’ ‘ধর’ শব্দও বলা হয়। আর এই কর্মকর্তাও এখন সচিব হলেন অনেক বঞ্চিত এবং সিনিয়র কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে। প্রশাসনের ১০ম ব্যাচ, ১১তম ব্যাচ এবং ১৫ ব্যাচের এখনো ১১৮ জন অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা আছেন, যারা সচিব হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। এমনকি বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা আছেন, যারা আওয়ামী লীগ আমলে একটিও পদোন্নতি পাননি। দীর্ঘ ১৬ বছর সিনিয়র সহকারী সচিব পদে কাটিয়েছেন। এদের সবাইকে ডিঙিয়ে জিয়াউল হক সচিব পদ বাগিয়ে নিলেন, তাও সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের মতো পদায়নে! যা অন্ততঃ ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের আমলে কেউ কল্পনাও করেননি!
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তাদের পুনর্বাসনে প্রকাশ্যে একের পর এক মুখ্য ভূমিকা পালন করছিলেন উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ। তবে নেপথ্য থেকে যারা মুখ্য ভূমিকা রাখছিলেন তারমধ্যে অন্যতম হলেন ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এ বি এম আব্দুস সাত্তার। উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবিরসহ আরও বেশ কয়েকজন রয়েছেন এরমধ্যে। সর্বশেষ এতে যুক্ত হলেন নতুন জনপ্রশাসন সচিব মো. এহছানুল হক। জনপ্রশাসন সচিব পদে ড. মোখলেস-উর-রহমানকে ফ্যাসিস্ট পুনর্বাসন, আর্থিক কেলেঙ্কারি এবং নারী কেলেঙ্কারির কারণে সরিয়ে দেয়া হয়। গত অক্টেবরে এই পদে পদায়ন পান এহছানুল হক। কিন্তু এই অল্প সময়েই অনেক কেলেঙ্কারি কাণ্ডের জন্ম দিয়েছেন তিনি। এ বি এম আব্দুস সাত্তার বিএনপির নাম ব্যবহার করে অর্থের বিনিময়ে গোপনে ফ্যাসিস্ট পুনর্বাসনের কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। এসবের মাধ্যমে তিনি ইতিমধ্যে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৩ আগস্ট, ২০১৩ সচিবালয়ে লাঞ্চিত ও ধাওয়া খেয়ে দ্রুত প্রস্থানের পর জিয়াউল হক বেশ কয়েকদিন আর সচিবালয়ে ঢোকেননি। তবে তলে তলে তিনি খুব দ্রুত সবকিছু লাইন ফেলেন মোটা অংকের টাকা দিয়ে। এরফলে তার আকর্ষণীয় পদায়ন হয় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে। সেখানে যোগদানের পর মন্ত্রণালয়ের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হকের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন রাতারাতি। গত অক্টোবরে মো. এহছানুল হক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হয়ে আসার পর জিয়াউল হককে এপিডি উইংয়ে পদায়নের আগ্রহ দেখান। এটি হলে জনপ্রশাসন সচিবকে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে, তাই এপিডিতে পদায়ন করা হয়নি। কিন্তু গত অক্টোবরের শেষে অনুষ্ঠিত এসএসবিতে জিয়াউল হক এবং তার স্ত্রী নূরুন্নাহার চৌধুরী- দু’জনকেই সচিব পদে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গণমাধ্যমে এ নিয়ে সমালোচনামূলক সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় জিয়াউল হকের পদোন্নতি আটকে যায়। তার স্ত্রী নূরুন্নাহার চৌধুরী ৩ নভেম্বর সচিব পদে পদোন্নতি পান। তাকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব করা হয়। আলোচিত সায়লা ফারজানা গ্রুপের সদস্য, ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তা নূরুন্নাহার চৌধুরীর ওই পদোন্নতি নিয়েও গণমাধ্যমসমুহে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এখন অবশেষে জিয়াউল হককেও সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হলো। তাও সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব পদে পদায়ন দেওয়া হলো, যেখানে সাধারণত সিনিয়র সচিবরাই পদায়ন পেয়ে থাকেন।