Banglar Chokh | বাংলার চোখ

“বয়কট ইন্ডিয়া” এখন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে রাজপথে 

জাতীয়

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০২:৪০, ১৭ মার্চ ২০২৪

সর্বশেষ

“বয়কট ইন্ডিয়া” এখন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে রাজপথে 

ছবি:সংগৃহীত

ভারতীয় আগ্রাসন থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় ‘ভারতীয় পণ্য বর্জনে’র আন্দোলন সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, এ আন্দোলন এবার রাজনৈতিক ময়দানেও আসছে। গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘ইন্ডিয়া আউট’ নামে এক ধরনের প্রচারণা বেশ জোরেশোরে হচ্ছে। সেখানে ভারতীয় পণ্য বর্জনসহ দেশটিকে ‘বয়কট’ নিয়ে করা বিভিন্ন ধরনের ক্যাম্পেইন চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই প্রচারণা নিয়ে বিবিসি বাংলা এবং দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ইন্ডিয়া আউট বা ভারতীয় পণ্য বর্জন এ আন্দোলন এখন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ময়দানেও দানা বেঁধে উঠছে। এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, ১২ দলীয় জোটসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ভারতীয় পণ্য বর্জনের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। শুধু তাই নয়, দেশের বুদ্ধিজীবী ও সুশীলসমাজের পক্ষ থেকেও ভারতীয় পণ্য বর্জন এবং এ দেশে অবৈধভাবে কর্মরত ভারতীয়দের তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর দাবি তুলেছেন।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়সে ভেলের ‘বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ভারতীয়দের দাপট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ ভারতীয় বিভিন্ন খাতে চাকরি করছেন। এদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশের ওয়ার্ক পারমিট রয়েছে। বেশিরভাগই আসেন ট্যুরিস্ট ভিসায়। অর্থাৎ সাড়ে ৪ লাখ ভারতীয় বাংলাদেশে অবৈধভাবে কাজ করছেন। এদের বেতন ডলারে ভারতেই পাঠিয়ে দেয়া হয়। সফটওয়্যার ও ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের কারণে বাংলাদেশের আইটি সেক্টরে ভারতীয়দের দাপট বেশি। ট্রাভেল এজেন্টদের বড় একটি অংশ ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণে। পোশাক খাতের টেকনিশিয়ান ও ডিজাইনার কাজে ভারতীয় বেশি। এমনকি সংবাদমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, কনসালটেন্সি, অ্যাকাউনটেন্ট, প্রশাসনিক খাতেও ভারতীয়রা রয়েছেন। এ ছাড়া ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে মোট বিদেশি দুই লাখ ৫০ হাজার। তাদের মধ্যে বৈধ ৯০ হাজার। বাকিরা অবৈধভাবে বাংলাদেশে আছেন। আর যারা বৈধভাবে আছেন তাদের মধ্যে ৫০ ভাগ কোনো অনুমতি না নিয়েই ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে কাজ করছেন। এই বিদেশিরা বছরে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাচার করেন।

এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ভারতীয়রা অবৈধভাবে এ দেশে কাজ করে কীভাবে। সম্প্রতি তিনি তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে লেখেন, অবৈধভাবে গরু আনতে গেলে ভারতীয় বাহিনীর হাতে গুলি খেয়ে প্রাণ হারায় বাংলাদেশের মানুষ। অবৈধভাবে ভারতীয়রা এদেশে কাজ করে কীভাবে? সেও এত বিপুল সংখ্যায়, দেশে এত প্রকট বেকার সমস্যা থাকার পরও। এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের উচিত সরকারের কাছে এসব প্রশ্ন তোলা। এর জবাব চাওয়া।

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এদেশের সাধারণ মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে যে, ভারত একটি ভোটারবিহীন যেনতেন নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় এনেছে। এর আগেও ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে ভারত আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় থাকতে সহায়তা করেছে। এ কারণেই মালদ্বীপের মতো বাংলাদেশেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা শুরু হয়। ধীরে ধীরে তা তরুণদের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে সরকারের কয়েকটি সিদ্ধান্ত এ আন্দোলনের পালে আরও বাতাস দিয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। সরকার রমজানে স্কুল খোলা রাখার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা ভারতের পরামর্শে নিয়েছে এমন ধারণা মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া ইফতার মাহফিল করতে নিরুৎসাহিত করছে সরকার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ইফতার মাহফিলে বাধা দিচ্ছে। এতে তরুণরা আরও বিক্ষুব্ধ হচ্ছে। প্রতিবাদে তারা গণইফতারের আয়োজন করছে। আর এসব কারণে জনগণের মনে ভারতের প্রতি ক্ষোভ আরও বাড়ছে।

সাবেক ছাত্রনেতা মোশারফ হোসেন গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের মনে ভারতের প্রতি ক্ষোভের অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ফারাক্কা বাঁধ। এ বাঁধের কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোর আজ মরণ দশা। এ ছাড়া রয়েছে সীমান্ত হত্যা। বাংলাদেশে ভারত বিদ্বেষী মনোভাবের অন্যতম কারণ একটা এই সীমান্তের হত্যাকা-। ভারতীয় সীমান্তের কাঁটাতারে কিশোরী ফেলানীর ঝুলন্ত লাশ এখনো এ দেশের মানুষের হুদয়কে নাড়া দেয়। জাতীয় নির্বাচনের দুই সপ্তাহ পর গত ২২ জানুয়ারি যশোরের বেনাপোল সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর গুলিতে মারা যান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) একজন সদস্য। হত্যাকা-ের তিন দিন পর তার লাশ ফেরত পায় বাংলাদেশ। ভারত বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রভাব খাটিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার বিষয়টিও এখন বেশ আলোচিত। তাই গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ভারত বিদ্বেষী মনোভাব আরও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর বর্তমানে রোজায় স্কুল খোলা রাখার সরকারের সিদ্ধান্ত এবং ইফতার মাহফিলে ছাত্রলীগের বাধা তরুণদের মনে ভারত বিদ্বেষকে আরও তীব্র করে তুলেছে। ভারতের পরামর্শে রোজায় স্কুল খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার এমনটা অনেকে মনে করেন। এতে তরুণদের মনে ক্ষোভ আরও বাড়ছে। তিনি বলেন, ভারতের পণ্য বর্জন আন্দোলন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে। বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এ ইস্যুতে স্পষ্টভাবে কথা বলছে। বিএনপি ভূ-রাজনৈতিক কারণে হয়তো স্পষ্ট করে কিছু বলছে না। তবে তারা এর বিরোধিতাও করছে না। তবে সময়ের সাথে সাথে এ আন্দোলন আরও বেগবান হবে এমনটাই মনে করি।

ভারতীয় পণ্য যেমন রূপচাঁদা তেল, কলগেট, মেসওয়াক, ডাবর এসব টুথ পেস্ট, এশিয়ান পেইন্ট, প্যারাসুট নারকেল তেল, উজালা, হুইল, পেঁয়াজ, ডাল এ ধরনের অরও অনেক পণ্য বাংলাদেশের বাজার দখল করে আছে। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এসব ভারতীয় পণ্য বর্জন করে নিজ দেশের পণ্য ব্যবহারের আহ্বান জানাচ্ছে অনেকে। রাজনৈতিকভাবে এ বিষয়ে জোরালো ভূমিকা পালন করছে এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, ১২ দলীয় জোটসহ আরও কয়েকটি দল।

এ বিষয়ে এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু ইনকিলাবকে বলেন, ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে আহ্বান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে তা দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে। অতীতেও বিভিন্ন সময়ে নানা প্রেক্ষাপটে বিদেশি পণ্য বর্জনের ডাক দেয়া হয়েছিল কিন্তু এবার অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সাড়া দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা এমনকি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন এমন লোকদের মাঝেও এই বর্জনের সাড়া দেখে কিছুটা অবাক হয়েছি। আমার ধারণা, ৭ জানুয়ারির প্রহসনমূলক নির্বাচনে ভারত সরকারের ভূমিকায় ব্যাপক বিক্ষুব্ধতা থেকে এই বর্জন ব্যাপক মাত্রা পেয়েছে।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর এ বিষয়ে বলেন, ভারতীয় আগ্রাসন থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে আন্দোলন চলছে, তা শহর থেকে গ্রাম-পাড়া-মহল্লা সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। বাংলাদেশ এখন বহুমুখী সংকটে পতিত। একদিকে দীর্ঘদিনের ভারতীয় আগ্রাসন। এদেশে কারা সরকারে থাকবে, বিরোধী দল কারা হবে। কে এমপি, মন্ত্রী হবে, কে প্রশাসনের শীর্ষ পদে নিয়োগ পাবে, তা ঠিক করে দেয় ভারত। সর্বত্র আজ ভারতীয় আধিপত্য। তিনি বলেন, বাংলাদেশে থাকা ভারতীয় এজেন্টদের চিহ্নিত করতে হবে। এ দেশে ১০ লাখের বেশি অবৈধ ভারতীয় লোক রয়েছে তাদের চিহ্নিত করে ভারতে ফেরত পাঠাতে হবে।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়