ঢাকা, রোববার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫

১৩ পৌষ ১৪৩২, ০৮ রজব ১৪৪৭

কুমিল্লা-০২ আসনে দ্বিধাবিভক্তি বিএনপি, চাঙা স্বতন্ত্ররা

মোর্শেদুল ইসলাম শাজু, হোমনা থেকে

প্রকাশ: ০০:২২, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫

কুমিল্লা-০২ আসনে দ্বিধাবিভক্তি বিএনপি, চাঙা স্বতন্ত্ররা

ফাইল ছবি

কুমিল্লা-০২ সংসদীয় আসন (হোমনা-তিতাস) আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দিন দিন উত্তাপ ছড়াচ্ছে এ দুই উপজেলার ভোটের রাজনীতিতে। বর্তমানে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি ছাড়াও এ আসনে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিভক্ত নেতৃত্ব এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের শক্ত অবস্থান।

স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এক সময়ের ‘ইস্পাত কঠিন’ বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হোমনা উপজেলা বর্তমানে দলীয় বিভাজনের কারণে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। হোমনা ও তিতাস উপজেলায় বিএনপির প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের মতানৈক্য ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে নির্বাচনী মাঠে। এরই মধ্যে বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও স্বতন্ত্র ৬ জনসহ মোট এগারো প্রার্থী কুমিল্লা -০২ (হোমনা ও তিতাস) আসন থেকে তাদের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এরা হলেন - বিএনপি থেকে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির কুমিল্লা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য নাজিম উদ্দিন মোল্লা, জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক সংসদ সদস্য আমির হোসেন ভূঁইয়া, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম, বাংলাদেশ ইসলামী ফন্টের আব্দুস সালাম ও স্বতন্ত্র মো. মাহমুদুল হাসান সাগর, ইঞ্চিনিয়ার মো. আবদুল মতিন, অ্যডভোকেট মো. আজিজুর রহমান মোল্লা, মো. রমিজ উদ্দিন (লভলী), মো. মনোয়ার হোসেন ও আব্দুল লতিফ সরকার।

বিএনপির মনোনীত প্রার্থীকে ঘিরে রয়েছে বিতর্ক। অভিযোগ রয়েছে, তিনি মূলত কুমিল্লা-০১ আসনের মেঘনা উপজেলার বাসিন্দা। বিষয়টিকে সামনে এনে ‘বহিরাগত’ তকমা দিয়ে জোরালো প্রচারণা চালাচ্ছেন একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী। স্থানীয় ভোটারদের একটি বড় অংশ মনে করছেন, এলাকার বাইরের কাউকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।

হোমনা সদরের এক ভোটার আবদুছ ছালাম বলেন, ‘আমরা চাই আমাদের এলাকার মানুষ সংসদে যাক। যিনি হোমনা ও তিতাসের মানুষের সুখ-দুঃখ বোঝেন, তাকেই ভোট দেবে মানুষ। বাইরের কাউকে হোমনার জনগণ ভোট দেয় না।’

এ অবস্থায় বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন একাধিক প্রভাবশালী নেতা। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক এপিএস ও অবসরপ্রাপ্ত সচিব ইঞ্জিনিয়ার আবদুল মতিন খান এবং সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও হোমনা উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. আজিজুর রহমান মোল্লা। দুজনেই ইতোমধ্যে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।

তাদের সমর্থন দিয়ে সঙ্গে রয়েছেন হোমনার আরেক সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি জহিরুল হক জহর। স্থানীয়ভাবে তারা জনপ্রিয় এবং নিজস্ব ভোটব্যাংক রয়েছে বলে মনে করছেন ভোটাররা। বিএনপির দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার পর পর তারা সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে ঐক্যের বার্তাও দেন। সাধারণ ভোটারদের ধারণা, এই নেতারা যদি একাট্টা হয়ে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে থাকেন, তাহলে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীর জন্য পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠতে পারে। এছাড়াও মেঘনা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি রমিজ উদ্দিন লন্ডনি তিনিও এই আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। 

মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে বিএনপির দ্বিধাবিভক্তি নিয়ে উপস্থিত সাংবাদিক ও নেতা-কর্মী-সমর্থকদের সামনে দেওয়া এক বক্তব্যে অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া বলেছেন, বিএনপি একটি বড় দল। একটি রাজনৈতিক দলের অনেকেই মনোনয়ন প্রত্যাশা করে, এটাই স্বাভাবিক। এ নিয়ে মনোমালিন্য থাকতে পারে, মান অভিমান থাকতে পারে, এগুলো থাকবে না। অন্যান্য দল ও স্বতন্ত্র অনেক প্রার্থীই থাকতে পারে- থাকবে। প্রতিযোগীতা না থাকলে তো আর এটার মর্যাদা থাকবে না। 

এদিকে আসন পুনর্বিন্যাস নিয়েও রাজনৈতিক অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি কুমিল্লা-০১ ও ০২ সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস করে মেঘনা উপজেলাকে দাউদকান্দির সঙ্গে রেখে কুমিল্লা-০১ এবং হোমনা উপজেলার সঙ্গে তিতাস উপজেলাকে যুক্ত করে কুমিল্লা-০২ আসন পুনর্বিন্যাস করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির কুমিল্লা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়ার পক্ষ থেকে একাধিক আপত্তি ও উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করা হয়েছে। হোমনার সঙ্গে মেঘনা উপজেলাকে যুক্ত করে কুমিল্লা-০২ আসন রাখার দাবিতে রিটটি এখনো বিচারাধীন রয়েছে।

সাবেক প্রধান্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রাক্তন এপিএস ইঞ্জিনিয়ার আবদুল মতিন খান বলেন, জনগণের দাবিতেই আমি নির্বাচন করছি। কুমিল্লা -০২, হোমনা ও তিতাস উপজেলাতেই যোগ্য প্রার্থী রয়েছে। দল যদি এ আসনের কাউকে মনোনয়ন দিত তাহলে আমরা তাকেই মেনে নিতাম। হোমনা ও তিতাসের মানুষ অন্য আসনের অন্য উপজেলার ‘বহিরাগত’ কাউকে মনোনয়ন দেওয়ায় তা মেনে নিতে পারছে না। আমি হোমনা ও তিতাস উপজেলার মানুষের সেবক হতে চাই। আমাকে যদি মানুষ সে সুযোগ দেয় ইনশাআল্লাহ তার মর্যাদা রক্ষা করবো।

স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন সংগ্রহকারী উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান মোল্লা বলেন, দীর্ঘদিন মাঠে ছিলাম। মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে ছিলাম, আছি। দলীয় কোন্দলে সাধারণ মানুষ যেন বঞ্চিত না হয়, সেটাই আমার লক্ষ্য।’

রাজনৈতিক মহলের মতে, এই আইনি অনিশ্চয়তা এবং পুনর্বিন্যাসের বিরোধিতা বিএনপির মনোনীত প্রার্থীকে স্থানীয়দের কাছে আপন করে তুলতে ব্যর্থ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হোমনা উপজেলা বিএনপির বর্তমান কমিটি নিয়ে অসন্তোষ। নতুন কমিটিতে পুরোনো ও সিনিয়র নেতাদের বাদ পড়ার অভিযোগ রয়েছে। এতে করে দলের একটি বড় অংশ কমিটির বাইরে চলে যায় এবং বিএনপি আরও বিভক্ত হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে, দীর্ঘ ১৭ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগেরও একটি ভোটব্যাংক এ এলাকায় তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগ সমর্থিত ভোটাররা শেষ পর্যন্ত কোন দিকে ঝুঁকবেন, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। স্থানীয়দের ধারণা, তারা নিজেদের বিবেচনায় সৎ, যোগ্য ও মানবিক কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থীর দিকেই ঝুঁকতে পারেন। ২০১৪ সালে বিনা ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী জোট জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্যও এবার মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। অবশ্য জাতীয় পার্টি প্রতিযোগিতামূলক আলোচনায় এখনও আসতে পারেননি।

এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ফ্রন্ট ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নির্বাচনী মাঠে থাকলেও হোমনা ও তিতাস উপজেলায় বিএনপির বাইরে অন্য দলের বড় কোনো ভোটব্যাংক নেই বলে মত স্থানীয়দের।

সবকিছু মিলিয়ে কুমিল্লা-০২ আসনে বিএনপি বর্তমানে কিছুটা ব্যাকফুটে রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সচেতন মহল। বিপরীতে বিএনপির বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বেশ ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন। তবে ভোটের অঙ্ক এখনই চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। বিএনপি একটি বড় ও জনপ্রিয় দল হওয়ায় দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দিকনির্দেশনা ও শেষ মুহূর্তের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পুরো চিত্র পাল্টে যেতে পারে বলেও মত সংশ্লিষ্টদের।

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন