ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৪:৫৩, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫
ছবি :সংগৃহীত
ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নজিরবিহীন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোতে হিন্দু জঙ্গিদের সহিংস বিক্ষোভ, হামলা, অগ্নিসংযোগ ও কূটনীতিকদের হত্যার হুমকির মতো ঘটনা অব্যাহতভাবে চলছে। নরেন্দ্র মোদি সরকারের মদতে শত শত উগ্রবাদী হিন্দু দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতাসহ বাংলাদেশের মিশনগুলোতে একের পর এক সহিংস বিক্ষোভ ও হামলা চালাচ্ছে।
এসব ঘটনাকে নিশ্চিতভাবেই পূর্বপরিকল্পিত বলে মনে করে বাংলাদেশ সরকার। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে এ বক্তব্য সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা কেবল কূটনৈতিক কর্মীদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়, বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, শান্তি ও সহনশীলতার মূল্যবোধেরও পরিপন্থী।
এদিকে ভারতীয় দূতকে তলবের প্রতিক্রিয়ায় গতকাল দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহকে অনানুষ্ঠানিকভাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়েছে বলে দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বি শ্যাম তলবের সময় বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে বলেছেন, বাংলাদেশ সম্প্রতি কয়েকটি ইস্যুতে অযৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। তখন এই অভিযোগ খণ্ডন করে হাইকমিশনার বলেন, বাংলাদেশ বিভিন্ন ইস্যুতে বাস্তবতার নিরিখে অবস্থান তুলে ধরছে।
গতকাল দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে উগ্রবাদী হিন্দুদের বিক্ষোভ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) ও বজরং দলের শত শত কর্মী হাইকমিশনের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভে অংশ নেন। সেখানে বাংলাদেশবিরোধী চরম উসকানিমূলক স্লোগানের পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কুশপুত্তলিকাও পোড়ানো হয়।
বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী দিপু দাস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এই বিক্ষোভ আয়োজন করা হয় বলে দাবি আয়োজকদের। এদিন বিক্ষোভকারীরা গেরুয়া পতাকা হাতে স্লোগান দিতে দিতে কূটনৈতিক এলাকার দিকে অগ্রসর হলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তারা পুলিশের বসানো ব্যারিকেড ভেঙে এগোনোর চেষ্টা করে। তখন গোটা হাইকমিশন এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
দিল্লির একাধিক কূটনৈতিক সূত্র জানায়, বিক্ষোভকারীরা অন্তত দুটি স্তরের ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি ও সংঘর্ষ হয়। বিক্ষোভকারীরা প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার হাতে স্লোগান দেন। এ সময় সেখানে ড. ইউনূসের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয় ।
পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েক বিক্ষোভকারীকে আটক করে এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়। পরে ফের ব্যারিকেড বসিয়ে হাইকমিশনের চারপাশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এর আগে, সম্ভাব্য বিক্ষোভের কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় অতিরিক্ত পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীও মোতায়েন করা হয়।
গতকাল সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে মুম্বাইতে । সেখানে উগ্রবাদীদের সহিংস বিক্ষোভে প্রায় ছয় ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশন। ওই কার্যালয়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের মুহূর্তগুলো কেটেছে ভয় এবং আতঙ্কের মধ্যে। মুম্বাইয়ের একাধিক কূটনৈতিক সূত্র আমার দেশকে জানায়, বিকাল ৩টা থেকে রাত পৌনে ৯টা পর্যন্ত অবুরদ্ধ ছিল বাংলাদেশ মিশন। বিকাল ৩টার দিকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ব্যানারে তিন হাজারেরও বেশি উগ্রবাদী হিন্দু সহিংস বিক্ষোভের মাধ্যমে বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা করে। এই সহিংস বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন মহারাষ্ট্র বিজেপির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান মহারাষ্ট্র সরকারের মন্ত্রী মঙ্গল প্রভাত। শুরুতে মুম্বাই পুলিশ ব্যারিকেট দিয়ে বিক্ষোভকারীদের ঠেকানোর চেষ্টা করে । তবে হঠাৎ ব্যারিকেড ভেঙে কয়েকশ উগ্রবাদী হিন্দু উপ-হাইকমিশনের ভেতরে চলে যায়। গেরুয়া পোশাকধারী এসব উগ্রবাদী উপ-হাইকমিশন ঘিরে হায়-হায় বাংলাদেশ ও জয়শ্রীরাম স্লোগান দিতে থাকে। এ সময় উপ-হাইকমিশনের কর্মকর্তারা আতঙ্কিত এবং নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েন। তবে পুলিশ শেষ পর্যন্ত বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়। অন্তত ২০০ জনকে আটক করে পুলিশ।
পরে বিক্ষোভকারীরা আজাদি ময়দানে বাংলাদেশবিরোধী সমাবেশ করে। সমাবেশে বাংলাদেশবিরোধী চরম উসকানিমূলক বক্তব্যও দেন উগ্রবাদী হিন্দু নেতারা। সমাবেশ শেষে মঙ্গল প্রভাতের নেতৃত্বে উগ্রবাদী হিন্দুদের একটি প্রতিনিধিদল রাত পৌনে ৯টায় বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনে গিয়ে স্মারকলিপি দেয়। স্মারকলিপিতে দিপু দাসের হত্যা, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের ঘটনাসহ বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর কথিত নির্যাতনের বিষয় তুলে ধরা হয়।
গতকাল কলকাতায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে ফের বিক্ষোভ করেছে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো। তবে ডেপুটি হাইকমিশন প্রাঙ্গণে পৌঁছানোর আগেই তাদের আটকে দেয় পুলিশ।
বঙ্গীয় হিন্দু জাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে এ প্রতিবাদ মিছিল ও ডেপুটেশনের কর্মসূচি নেওয়া হয়। শিয়ালদহ রেল স্টেশনের সামনে থেকে তাদের মিছিল শুরু হয়। শত শত কর্মী-সমর্থক নিয়ে মিছিলটি বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে যাওয়ার চেষ্টা করলে কলকাতার বেগবাগানের সামনে তাদের আটকে দেয় পুলিশ। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা প্রথম ব্যারিকেডটি ভেঙে ফেললে পুলিশের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তি শুরু হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। মিশনের অন্তত একশ মিটার দূরে বিক্ষোভকারীদের আটকে দেয় পুলিশ। তখন বিক্ষোভকারীরা পাল্টা পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। এতে কয়েক পুলিশ সদস্য আহত হন।
এ সময় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ পুলিশের আরো ইউনিট এসে বিক্ষোভ থামানোর চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে কয়েকজনকে আটক করে কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তর লালবাজারে নেওয়া হয়। বিক্ষোভকারীদের মধ্যেও বেশ কয়েকজন আহত হন। তাদের কলকাতার নীলরতন হাসপাতাল ও পিজি হাসাপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কলকাতায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশন চত্বর কড়া নিরাপত্তায় ঘিরে রাখা হয়েছে।
সন্ধ্যায় একই এলাকায় আবার মিছিল করে বামপন্থি দলগুলো। তাদের মিছিলও ২০০ মিটার আগেই থামিয়ে দেয় পুলিশ। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী), সিপিআই, বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল বা এসএসপি, ফরোয়ার্ড ব্লক এতে অংশ নেয়।