ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫

১২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২, ০৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৭

এলডিসি উত্তরণ ও বন্দর নিয়ে

দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্তের অধিকার কেবল নির্বাচিত সরকারের

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ১১:৩৫, ২৫ নভেম্বর ২০২৫

দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্তের অধিকার কেবল নির্বাচিত সরকারের

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।  ফাইল ছবি

একটি বিদেশি কোম্পানির কাছে চট্টগ্রাম বন্দরের একটি গুরুত্বপূর্ণ কন্টেইনার টার্মিনাল দীর্ঘমেয়াদে লিজ দেয়ার কড়া সমালোচনা করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, একটি অনির্বাচিত সরকারের এমন পদক্ষেপ নেয়া উচিত নয়। তিনি সোমবার রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে আইডিতে লিখেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে তাকান। এ যাবত কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য যা করতে পেরেছে তার চেয়ে সেখানে যা ঘটে তা লাখ লাখ মানুষের জীবনধারাকে প্রভাবিত করে।  সম্প্রতি বন্দর নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে তা রুটিন কাজ নয়। 

ফেসবুকে দেয়া তার পুরো পোস্টটি এখানে তুলে ধরা হলো- ‘গাজীপুরের এক ছোট গার্মেন্টস কারখানার মালিককে কল্পনা করুন। তিনি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তার ব্যবসা গড়ে তুলেছেন- শতাধিক কর্মীকে কাজ দিয়েছেন, অতি সামান্য মুনাফায় টিকে থেকেছেন, আর কঠিন বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার মধ্যে নিজেকে ধরে রেখেছেন। একদিন, কোনো আনুষ্ঠানিকতা বা ঘোষণা ছাড়াই, সেই শুল্ক-সুবিধাগুলো- যা একসময় তার পণ্যের দামকে প্রতিযোগিতামূলক রাখত, তা নীরবে উঠে যায়। অর্ডার কমতে শুরু করে, আর চাপ বাড়তে থাকে- কেমন করে কারখানা চালু রাখবেন, কর্মীদের বেতন দেবেন, পরিবারকে নিরাপদ রাখবেন?

এবার নারায়ণগঞ্জের এক তরুণ স্নাতককে ভাবুন, যিনি অসহায়ভাবে দেখছেন তার পরিবার অনিশ্চয়তার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। তার বাবা একটি কারখানায় কাজ করেন। সংসার চালাতে ওভারটাইমের ওপর নির্ভর করেন। যখন রপ্তানির ওপর চাপ বাড়ে, প্রথমেই ওভারটাইম বন্ধ হয়। তারপর শিফট কমে। তারপর চাকরি। এগুলো কোনো খবরের শিরোনাম হয় না। এগুলো সাধারণ ঘরের নীরব সংকট।

তারা কখনও এই সিদ্ধান্তে ভোট দেয়নি। তাদের কখনও জিজ্ঞেসও করা হয়নি। তাদের সামনে কখনও প্রকৃত হিসাব-নিকাশও রাখা হয়নি। এই কারণেই বাংলাদেশের এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণের বিতর্কটি সরকারি বিবৃতি যতটা সহজ করে দেখায়, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি আগেও বলেছে- ২০২৬ সালের উত্তরণের সময়সীমা ধরে রেখে পিছিয়ে দেয়ার সুযোগ বন্ধ করে দেয়া- এটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এটি একটি অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত, যার জনগণের নির্বাচনী ম্যান্ডেট নেই। অথচ তারা এমন দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, যা বহু দশক ধরে দেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে। আমাদের বলা হচ্ছে- সময় বাড়ানো ‘অসম্ভব’, পিছিয়ে দেয়ার অনুরোধ জানানো হবে ‘লজ্জাজনক’, আর জাতিসংঘ (ইউএন) তা বিবেচনাই করবে না।
কিন্তু একটু গভীরভাবে দেখলে, ইতিহাস অন্যরকম গল্প বলে।

অ্যাঙ্গোলা ও সামোয়ার মতো দেশগুলো তাদের উত্তরণের সময়সীমা পরিবর্তন করেছে। জাতিসংঘের নিয়মেও বলা আছে- কোনো দেশ অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলালে নমনীয়তা দেয়া যায়। তাই দেশের ভবিষ্যৎ গঠনের মতো বিষয়ে সময় চাইলে সেটি একটি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমরা কেন এমন ভান করছি যে কোনো বিকল্প নেই? কেন আমরা নিজেরাই আমাদের ভবিষ্যৎ সীমিত করে দিচ্ছি? প্রকাশ্যে পিছিয়ে দেওয়ার বিকল্প বাদ দিলে আমরা নিজেরাই আমাদের দরকষাকষির শক্তি দুর্বল করি। আন্তর্জাতিক আলোচনায় আমরা টেবিলে বসার আগেই নিজের সব কার্ড খুলে দিই- যা আমাদের হাতকে দুর্বল করে।

সরকারের নিজের নথিতেও উল্লেখ আছে যে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক মহল ইতিমধ্যেই ব্যাংকিং খাতের চাপ, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, ঋণঝুঁকি বৃদ্ধি, রপ্তানি শ্লথ হওয়া- এসব অনুভব করছে। এটি উত্তরণের বিরোধিতা নয়। বাংলাদেশ উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। কিন্তু ‘উত্তরণের অধিকার’ থাকা আর ‘উত্তরণের প্রস্তুতি থাকা’- এই দুই এক নয়। আমার কাছে সত্যিকারের জাতীয় শক্তি হলো- সন্দেহহীন সিদ্ধান্ত নয়; বরং এমন শৃঙ্খলা, যা কঠিন প্রশ্নগুলো আগেভাগে করতে শেখায়, যাতে খরচ অপরিবর্তনীয় হয়ে না ওঠে।

এখন চট্টগ্রাম বন্দরকে দেখুন- বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবেশদ্বার। সেখানে যা ঘটে, তা কোনো রাজনৈতিক বক্তৃতার চেয়ে অনেক বেশি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। সম্প্রতি বন্দরের বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্তগুলো সাধারণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়। এগুলো কৌশলগত, জাতীয় সম্পদ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত- যা একটি অন্তর্বর্তী সরকার নিচ্ছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর বাধ্যবাধকতা তৈরি করে, অথচ তাদের কোনো গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট নেই।

চট্টগ্রাম বন্দরে আমরা যা দেখছি, সেটিই এলডিসি উত্তরণ নিয়েও ঘটছে। কৌশলগত বিকল্পগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। জনমতকে অসুবিধা হিসেবে দেখা হচ্ছে। সঙ্গত উদ্বেগগুলো ‘গতি’ ও ‘অনিবার্যতা’র নাম করে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।

আমি পরিষ্কারভাবে বলি: এটি ব্যক্তিবিশেষ বা কাউকে আক্রমণ করার বিষয় নয়। এটি প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করা, এবং সেই নীতিকে রক্ষা করা- যে সিদ্ধান্তগুলো ভবিষ্যতের দশক গঠন করবে, সেগুলো এমন সরকারেরই নেয়া উচিত, যারা জনগণের কাছে জবাবদিহি করে।

কেউ বলছে না যে আমরা এলডিসি থেকে উত্তরণ করব না, বা আমাদের বন্দর সংস্কার করা উচিত নয়। দাবি আরও সহজ এবং মৌলিক: একটি দেশের ভবিষ্যৎ সেই সরকার দ্বারা স্থির হওয়া উচিত নয়, যেটিকে জনগণ নির্বাচন করেনি।
কৌশলগত ধৈর্য কোনো দুর্বলতা নয়। জনসম্পৃক্ততা কোনো বাধা নয়। গণতান্ত্রিক বৈধতা কোনো বিলম্ব নয়। আর আমার মতে, এ সবকিছুর নিচে যে সত্যটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো-  বাংলাদেশের মানুষ কখনও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিষ্ক্রিয় ছিল না। তারা কঠিন সময় ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে গেছে, কারণ তারা মর্যাদা, অধিকার, এবং পছন্দে বিশ্বাস করে। তাদের দাবি খুব সহজ: তাদের কথা শোনা হোক, তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হোক, তাদের সম্মান করা হোক। এ কারণেই অনেকে আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে- একটি সুযোগ, যাতে বাংলাদেশের মানুষ তাদের মত জানাতে পারে, বেছে নিতে পারে, এবং একটি সরল সত্য আবার ঘোষণা করতে পারে: এই দেশের ভবিষ্যৎ সেই মানুষদের হাতেই গড়ে উঠতে হবে-যারা এখানে বাস করে, এবং যারা ‘সবার আগে বাংলাদেশ’-এ বিশ্বাস করে বলেও উল্লেখ করেন তারেক রহমান।

উল্লেখ্য, এদিকে চট্টগ্রামের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্প এবং ঢাকার কাছে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দুটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া  নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে। দীর্ঘ মেয়াদী এই চুক্তি করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাড়াহুড়ো করলো কিনা  সে প্রশ্নও সামনে এসেছে।  সম্প্রতি দুটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিও সই করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। চট্টগ্রামের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালে ডেনমার্কভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালস এবং পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালে কাজ করবে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মেডলগ

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন