ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫

১৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২, ০৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৭

ডিএসএ থেকে সিএসও: সংকটে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ১৭:৩৫, ২৪ নভেম্বর ২০২৫

ডিএসএ থেকে সিএসও: সংকটে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা

.

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর ২০১৮ সালের বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) যে প্রভাব ফেলেছে তা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করেছে ক্লুনি ফাউন্ডেশন ফর জাস্টিসের ট্রায়াল ওয়াচ ইনিশিয়েটিভ এবং সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস)।  বাংলাদেশের গণমাধ্যম বিষয়ক বিভিন্ন সরকারের আইনি সংকট নিয়ে মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মানবাধিকার বিষয়ক এসব সংগঠন। যেখানে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে হওয়া সাইবার সিকিউরিটি অর্ডিন্যান্স (সিএসও) এর একটি ধারা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। 

ক্লুনি ফাউন্ডেশন ফর জাস্টিসের ওয়েব সাইটে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট বলছে, মোট ৩৯৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দায়ের করা ২২২টি মামলার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে তারা। এই বিশ্লেষণ দেখায় কীভাবে অনলাইন প্রতিবেদন, সমালোচনা ও স্বাধীন মতপ্রকাশকে দমন করার জন্য এসব আইন শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। 

ওই প্রতিবেদনে ডিএসএ’র কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন ৩০ জন সাংবাদিকের মর্মস্পর্শী সাক্ষাৎকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
২০০৬ সালের বহুল সমালোচিত আইসিটি আইনের বদলে ডিএসএ প্রণীত হলেও, আইসিটি আইনের বহু বিতর্কিত ধারা অপরিবর্তিতভাবে ডিএসএ এবং পরবর্তী ২০২৩ সালের সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের (সিএসএ) মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যার মাধ্যমে আইনের ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে। প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীনরা এসব আইনকে হয়রানি ও ভয় দেখানোর প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।

এই আইন ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদ এবং অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মামলা করেছেন। তারা আইনটিকে ব্যক্তিগত প্রতিশোধের কাজে ব্যবহার করেন। ফলে সাংবাদিকরা প্রায়শই ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার হয়েছেন। পাশাপাশি দোষী নয় এমন অনেক সাংবাদিককে মামলার মুখোমুখি করেছে এই আইন। ভুক্তভোগী সাংবাদিকদের প্রায় অর্ধেকই শারীরিক নির্যাতন বা খারাপ আচরণের অভিযোগ করেছেন। যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর ইঙ্গিত।

এক চাঞ্চল্যকর দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের জেরে ক্ষমতাসীন দলের এক ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সেই সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন, পাঁচ-ছয়জন কর্মকর্তা তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং সরকারবিরোধী মনোভাব আছে কি না তা জানতে বৈদ্যুতিক শক দেন।

ট্রায়াল ওয়াচের সিনিয়র লিগ্যাল প্রোগ্রাম ম্যানেজার মেনেকা খান্না মন্তব্য করেন, আইসিটি আইনের মতো ডিএসএ-ও অস্পষ্ট ও বিস্তৃত ধারার মাধ্যমে প্রতিবেদন ও মতপ্রকাশকে অপরাধে পরিণত করেছে। এর ফলে পুলিশ প্রায় বাধাহীনভাবে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার ও তাদের ডিভাইস জব্দ করতে পারত। প্রতিবেদনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। তা হলো- ডিএসএ’র বেশিরভাগ মামলাই শেষ পর্যন্ত আদালত পর্যন্ত পৌঁছায়নি। যে কয়েকটি মামলার বিচার হয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবকটিতেই সাংবাদিকেরা খালাস পেয়েছেন। তবে একাধিক সাংবাদিক দোষী সাব্যস্তও হয়েছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব আচরণ পরিষ্কারভাবে মামলাগুলোর ভিত্তিহীন প্রকৃতিরই ইঙ্গিত দেয়। তবে মামলা করার এই প্রক্রিয়াই সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত, আর্থিক ও পেশাগত জীবনে দীর্ঘস্থায়ী ও অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। যদিও ডিএসএ ২০২৩ সালে বাতিল করা হয়েছে, তবে প্রতিবেদনে উল্লেখিত ঝুঁকিগুলো এখনও পুরোপুরি দূর হয়নি বলে দাবি করা হয়েছে। চলতি বছর অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক জারি করা সাইবার সিকিউরিটি অর্ডিন্যান্সে-২০২৫ (সিএসও) ডিএসএ ও সিএসএ-এর বেশ কিছু সমস্যাযুক্ত ধারা সংশোধন বা বাতিল করা হয়েছে। তবুও সিএসও’র ২৬ নম্বর ধারার মতো অস্পষ্ট বিধান- যা ধর্মসম্পর্কিত বা উদ্বেগ সৃষ্টি করে এমন বক্তব্যকে শাস্তিযোগ্য করেছে। অর্থাৎ এখনো এই আইন মতপ্রকাশ দমনে ব্যবহৃত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

সিজিএস সভাপতি জিল্লুর রহমান জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা দীর্ঘদিন ধরে বাধার মুখে রয়েছে এবং ডিএসএ সেই স্বাধীনতাকে আরও সংকুচিত করেছে। ভবিষ্যৎ আইন যাতে আবার মতপ্রকাশ বা সংবাদমাধ্যম দমনের অস্ত্র না হয়, সেজন্য ডিএসএ-এর প্রভাব গভীরভাবে পর্যালোচনা করা জরুরি। ভবিষ্যৎ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এমন একটি পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে যেখানে গণমাধ্যম কোনো চাপ ছাড়াই কাজ করতে পারে। এই লক্ষ্যে নাগরিক সমাজ ও সুশীল সমাজের অব্যাহত ভূমিকা অপরিহার্য।

উৎস:মানবজমিন

আরও পড়ুন