নিজস্ব প্র্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:১৫, ২৪ নভেম্বর ২০২৫
ফাইল ছবি- জামায়াত আমীর
খতিব-ইমামদের মর্যাদা তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। সমাজের ফয়সালা মসজিদের মিম্বর থেকে হবে এমন স্বপ্নের কথা উল্লেখ করে জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমাদের ইমাম এবং খতিব সাহেবরা কারও করুণার পাত্র হবেন এটা আমরা চাই না। তিনি বলেন,যেদিন নামাজের ইমাম সমাজের ইমাম হবেন সেইদিন সত্যিকারের মুক্তি মিলবে ।
রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে সম্মিলিত ইমাম-খতিব জাতীয় সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম মাওলানা মুহিব্বুল্লাহিল বাকি নদভীর সভাপতিত্বে দুপুর ২টায় এ সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা, মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অধিকার সংরক্ষণ, ইমাম-খতিবদের সামাজিক নিরাপত্তা, সম্মানজনক ভাতা এবং মসজিদ পরিচালনার আধুনিক নীতিমালা প্রণয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপস্থাপিত হয়।
জামায়াত আমীর বলেন, আমরা যখন জীবিত আপনারা (ইমাম-খতিব) ইমামতি করেন আমরা পেছনে দাঁড়িয়ে যাই। আমরা যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিই, তখনো আপনারা (ইমাম-খতিব) আমাদের ইমাম। শুধু ব্যতিক্রম এতটুকু। জীবিত অবস্থায় আপনাদের পেছনে দাঁড়াই। আর দুনিয়া থেকে চলে গেলে আমাদের লাশটা সামনে রেখে আপনারা দাঁড়ান। আপনারা হায়াতেও ইমাম মউতেও ইমাম।
রাসূলে কারীম (সা.) মহান রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে দায়িত্ব পেয়েই মসজিদ গড়েছিলেন এবং মসজিদকে আল্লাহ তাআলার পছন্দ অনুযায়ী মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন উল্লেখ করে জামায়াত আমীর বলেন, তখন আলাদা কোনো ক্যাবিনেট হাউজ ছিল না এবং আলাদা কোনো রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ছিল না। সমস্ত আঞ্জাম দেয়া হতো মসজিদে নববী থেকে। বিভিন্ন ধর্মের, মতের মানুষ, সারা বিশ্ব থেকে প্রতিনিধি নিয়ে তার কাছে এসেছেন। তিনি তাদের সবার সঙ্গে মিলিত হয়েছেন মসজিদে নববীতে। রাষ্ট্রের সব কর্মকাণ্ডের পরামর্শ আহলে রায়েদের সঙ্গে করেছেন মসজিদে নববীতে। আর এই মসজিদকেন্দ্রিক যে সমাজটা দুনিয়ার যে অঞ্চলে ছিল সেই সমাজই ছিল বিশ্বের ভালো সমাজ। আর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু সাল্লাম যে সমাজ মসজিদে নববীকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছিলেন সেই সমাজ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তিনি সার্টিফাই করে গিয়েছেন, ‘বিশ্ববাসী তোমরা জেনে রাখো আজ আমি যে সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি আল্লাহর কিতাবের ভিত্তিতে এই সমাজটাই হচ্ছে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ।’ এর আগে এই ধরনের কোনো সমাজ জন্ম নেয়নি। ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো সমাজ জন্ম নেবে না। ডা. শফিকুর রহমান বলেন, সুতরাং ওই সমাজকে অনুসরণ করে যেই সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে সেই সমাজ ব্যবস্থায় দুনিয়ায় শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসবে। নবীজির সমাজকে বাদ দিয়ে মন গড়া কোনো মতবাদ তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে যে সমাজ গড়া হবে সেই সমাজ আল্লাহর কসম দুনিয়াতে শান্তি এবং সম্মান কোনোটাই দিতে পারবে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ। এদেশের ৯০ ভাগ মুসলমান আল্লাহর ওপর ইমান রাখে। আল্লাহর কোরআনকে মানে, নবী করীম (সা.) কে শেষ পয়গম্বর স্বীকার করে। এই দেশে আইন চলবে কোরআনের মতবাদেই ইনশাআল্লাহ। এদেশে অন্য ধর্মের মানুষ যারা আছে তাদের কি হবে? এমন প্রশ্ন তুলে নিজেই উত্তর দেন জামায়াত আমীর। তিনি বলেন, কোরআন শুধু মানুষের সম্মানের গ্যারান্টি দেয় নাই। অধিকারের ওয়ারেন্টি দেয় নাই। কোরআন সমস্ত মাখলুকাতের অধিকারের ওয়ারেন্টি দিয়েছে। মানুষ তো অবশ্যই, মদীনায় যেমন সব ধর্মের মানুষ পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা নাগরিক নিরাপত্তা এবং অধিকার ভোগ করেছেন, আল্লাহর দেয়া আইনের এবং বিধানের ভিত্তিতে আমাদের প্রিয় দেশেও যদি সেই সমাজ ব্যবস্থা কায়েম হয় ইনশাআল্লাহ তাআলা।
ইমাম-খতিবদের জন্য উত্থাপিত সাত দাবির মধ্যে একটা দাবি-মসজিদ কমিটি ইমাম এবং খতিব সাহেবদের সম্মানের সঙ্গে একমোডেট করতে হবে। এর বিপক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, আমি এই দাবির সঙ্গে একমত না। মসজিদ কমিটি হবে ইমাম এবং খতিব সাহেবের পরামর্শের ভিত্তিতে। এই কমিটির প্রাণপুরুষ হবেন খতিব কিংবা ইমাম। তাকে বাদ দিয়ে নয়।
তিনি বলেন, খতিব এবং ইমাম সাহেবরাও মানুষ। তারাও ভুলের ঊর্ধ্বে নন। ভুল তো হতেই পারে। ভুল যদি হয় এর সমাধান করতে হবে সম্মানজনকভাবে। এই সমাধান এইভাবে নয়। আমার পছন্দ হয়নি, আমি দুপুরবেলা জোহরের নামাজের সময় বলে দিলাম যে উনি কীভাবে ইমাম থাকেন আমি দেখে নেবো। আসরের নামাজের সময় দেখা গেল উনি আর মেহরাবে নাই, আমাদের ইমাম এবং খতিব সাহেবদের জন্য আমরা এমন ফয়সালা চাই না।
ইসলামের পক্ষে গণজোয়ার তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে ইসলামী আন্দোলনের আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, আলেমদের ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহারের কোনো সুযোগ কাউকে দেয়া যাবে না। তিনি বলেন, অতীতে বারংবার উলামায়ে কেরামের সরলতার সুযোগ নিয়ে অনেকে স্বার্থ হাসিল করেছেন। উলামায়ে কেরামকে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সেই সুযোগ আর কেউ যেন নিতে না পারে সেই বিষয়ে সম্মানিত উলামায়ে কেরামকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
মুফতি রেজাউল করীম বলেন, অতীতে উলামায়ে কেরামকে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। খুন-গুম-মামলা-মোকাদ্দমার মধ্যদিয়ে যেতে হয়েছে। সেই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হতে দেয়া যাবে না। বর্তমানে ইসলামের পক্ষে গণজোয়ার তৈরি হয়েছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। আমরা ইসলামের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ থাকলে আগামীর বাংলাদেশ হবে ইসলামের বাংলাদেশ।
শুধু কয়েকটি দলের ঐক্যে সবার ঐক্য হয় না বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেছেন, জাতীয় ঐক্য কয়েকটি দলের ঐক্য না, সবার ঐক্য, যেখানে আলেম-ওলামার ঐক্যও গুরুত্বপূর্ণ। দেশ গঠনের দায়িত্ব সবার, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে ঐক্য প্রয়োজন। তাই এনসিপি আলেম-ওলামার ৭ দফা দাবির সমর্থন করে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, আলেম-ওলামাদের দায়িত্ব অনেক বেশি, রাষ্ট্র সংস্কারের সঙ্গে সামাজিক সংস্কারও গুরুত্বপূর্ণ। শুধু রাষ্ট্র নয়, সমাজ পুনর্গঠনও করতে হবে; ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গিয়ে ইনসাফের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি বলেন, ইসলামবিরোধী রাজনীতি করেছে আওয়ামী লীগ। ভারতের দালালি করেছে। ইসলামের স্পিরিটকে বাধাগ্রস্ত করেছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদ দূর হয়েছে। তবে দেশকে নতুন করে গড়তে অনেকটা সময় নিতে হবে।
সম্মেলনে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমীর মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব সাখাওয়াত হোসেন রাজি, হেফাজত নেতা জুনায়েদ আল হাবিব প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সম্মেলনে ইমাম-খতিবদের সাত দফা দাবি তুলে ধরেন মাওলানা আজহারুল ইসলাম।